পাংচুয়্যাল পাখি 

পাংচুয়্যাল পাখি
অন্তরা চৌধুরি

আমার বাবা যখন কোলিয়ারির কোয়াটারে থাকতেন, তখন রোজ দেখতাম সকাল হলেই পাখিকে চাল আর জল দিতে। পাখিগুলোও বোধহয় অপেক্ষা করে থাকত। খেতে দেওয়া মাত্রই তারাও কিচিরমিচির শব্দে সকালটা ভরিয়ে তুলত। চাল আর জল খেত। কখনও জলে গা ডুবিয়ে সকাল সকাল স্নান সেরে নিত। সামনেই ছিল একটা মাধবীলতা গাছ। আমার বাবা ভোর হতে না হতেই দরজা জানলা খুলে দিয়ে চুপ করে বসে ভোরের দৃশ্য দেখতেন। আমাকে বলতেন, ‘দেখ, সকালটা কী সুন্দর। প্রকৃতিকে ঘরের মধ্যে আনা খুব কঠিন।’ আমি আর বাবা দু’জনে মিলে সকাল দেখতাম। পাখির কলতান আর মাধবীলতার সুগন্ধে ভেজা সে এক অপরূপ সকাল।
বিয়ের পর সল্টলেকে যখন এলাম, দেখলাম বেশ নিরিবিলি জায়গা। কলকাতার হইহট্টগোল মুক্ত। চারপাশে প্রচুর গাছ। সেখানে পাখিও প্রচুর। কিন্তু তাদেরকে ফ্ল্যাটের এই ছোট্ট ব্যালকনিতে নিয়ে আসব কীভাবে! বাবার কথা মনে পড়ল। শুরু হল সাধনা। প্রতিদিন একটা প্লেটে একটু করে বিস্কুট আর বাটিতে জল রেখে দিই। কিন্তু যেখানকার বিস্কুট সেখানেই পড়ে থাকে। কেউ আসে না। খায়ও না। জানতাম বনের পাখি এত সহজে ধরা দেবে না। তবে হাল ছাড়িনি। একদিন ব্যালকনিতে চড়াই দেখা গেল। তারা এসে গ্রিলে বসছে। কিন্তু ঠিক খেতে সাহস পাচ্ছে না। তারপর বিস্তর গবেষণা করে ওরা বুঝল, এখানে ওরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। কেউ ওদের কোনও ক্ষতি করবে না। তখন ওরা সদলবলে আসতে শুরু করল। চড়াইয়ের পর একদিন এল শালিক। সকাল হলেই আমি দরজা জানলা খুলে চুপ করে বসে ওদের খুনসুঁটি দেখতাম। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ওরা চলে আসত। একটু বিস্কুট একটু জল খেয়ে কিছুটা খাবার ছেলেমেয়েগুলোর জন্য মুখে করে নিয়ে যেত। তারপর আবার সকাল সাতটার সময় যখন চারপাশে বেশ ঝলমলে রোদের গন্ধ বের হতো, তখন ওরা আবার আসত। তখন আর শুধু খেতে নয়। আমাদের খোঁজ-খবর নিতে। আমি চুপ করে বসে দেখতাম ওদের কাণ্ডকারখানা। একটু বিস্কুট খেয়েই পায়ে পায়ে আমার ঘরের ভেতর ঢুকে যেত। গোটা ঘর চলে ফিরে বেড়াত। ঘাড় উঁচু করে সরজমিনে তদন্ত করে দেখত যে সব ঠিকঠাক আছে কি না। মাঝে মাঝে মনে হত আমার অতি প্রিয়জন পাখিরূপে আমার কাছে এসেছে। তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে শরীর ফুলিয়ে চ্যাঁ চ্যাঁ করে কত কী যে বলে যেত। ইস! আমি যদি বুঝতে পারতাম!
তারপর চড়াই আর শালিকের হাত ধরে এল কাঠঠোকরা, হাঁড়িচাঁচা, ফিঙে, ছাতারে আর পায়রা। কাক তো আছেই। খাবার শেষ হলেই এসে চিৎকার জুড়ে দেয়। প্রথম দিকে প্রায় সারাদিন ধরেই খাবার দিতাম। পরে দেখলাম যে হারে পাখির সংখ্যা বাড়ছে, তাতে ওদেরকেও সময় এবং শৃঙ্খলার বন্ধনে বাঁধতে হবে। ওদেরও ডিসিপ্লিন শেখাতে হবে। তাই ঠিক করলাম ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ আর ডিনার। সেইমতো ওদের অভ্যেস করাতে শুরু করলাম। কিছুদিনের মধ্যেই একটু একটু করে ওরা ব্যাপারটা বুঝে গেল। এটাও বুঝল যে অসময়ে বিরক্ত করে কোনও লাভ হবে না। এতদিন আদরে আদরে বাঁদর হয়েছে। এবার দিদিমণিকে একটু কড়া হতেই হবে। ওরা প্রকৃতির সন্তান। ওদের কাছে ঘড়ি না থাকলে কী হবে, সময়জ্ঞান ষোলোয়ানা আছে। তাই ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আমার ব্যালকনি বিচিত্র পাখির কলতানে ভরে যায়। সেই আওয়াজে কার সাধ্য যে বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোয়! অগত্যা উঠতেই হতো। তবে এক এক প্রজাতির পাখি এক এক সময়ে আসে। কারণ একসঙ্গে এলেই ওরা মারপিট করে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার এই পাখিদের মধ্যেও আছে। তাই মিউচুয়্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা ওরা নিজেদের মধ্যেই সেরে নিয়েছিল।
এতদিন পাখিদের সঙ্গে সংসার করে এটুকু বুঝেছি কোনটা ওদের খিদে পাওয়ার ডাক, কোনটা খাবার পছন্দ না হওয়ায় রেগে গজরানোর ডাক, আর কোনটা ভালবাসার ডাক। বাড়িতে কোনও খাবার বেঁচে গেলে ওদের দিয়ে দেখেছি- খুব অনিচ্ছা সহকারে খায়। পায়রাকে কেনা চালের বদলে রেশনের চাল দিলে চুপ করে কার্নিশে বসে থাকে। গজরায়। চালের দিকে ফিরেও তাকায় না। আমার মা তো দেখে অবাক। বলে-‘এ কী অভ্যেস করিয়েছিস তুই? রেশনের চাল দিলাম। খেলো না।’ আমি বললাম, ‘ওরা স্মার্ট বাজারের চাল খায়। ওদের মুখ পাশ করা। পায়রা বলে কী ওদের কোনও স্বাদ থাকতে নেই!’ আমার পিসিমণি তাঁর পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনকে বলেন, আমার নাকি সকাল থেকে কাজ-পাখি চরানো। লোকে গরু চরায়। আমি পাখি চরাই।
দুপুর বেলায় আমরা খেতে বসার আগে ওদেরকে খাইয়ে দিই। না হলে শান্তিতে দুটো খেতেও দেবে না। বিকেলে কর্তা অফিস চলে যেত। আমি ঋতু বদল দেখতাম। সূর্যের বদলে যাওয়া আলোর রঙ দেখতাম। এই পুজোর সময় রোদটা কড়া হলেও কেমন যেন আনন্দে ভরা। এমন নীল আকাশ আর এমন রোদ শুধু এই পুজোর সময়েই দেখা যায়। কখনও ঠাকুর ঘরে, কখনও শোবার ঘরে কখনও রান্নাঘরে শরতের রোদ খেলা করে বেড়াত। রোদের তেজ একটু কমতে না কমতেই এক এক করে পাখিদের আসা শুরু হত। তারা শেষ বিকেলে ডিনার সেরে যে যার ঘরে ফিরে যেত। ওদের খাওয়ানো শেষ হলে আমি ছাদে যেতাম। দেখতাম সব ফ্ল্যাটের ছাদেই কী অসংখ্য পাখি বসে রয়েছে। সকলেরই তো একটু আড্ডা প্রয়োজন। সারাদিন কাজের শেষে ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটু বিনোদন ওদেরও দরকার।
সম্পূর্ণ নীরব হওয়ার আগে প্রকৃতি এমনই মুখর হয়ে ওঠে-
‘এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে’
একদিন সন্ধে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঠিক তার আগের মুহূর্তে। তখনও প্রকৃতির বুকে আলোজ ভগ্নাংশ অল্প একটু থেকে গেছে। ব্যালকনিতে একটা অদ্ভুত শিষ দেওয়ার আওয়াজ পেলাম। অল্প দরজা খুলে দেখি সাদা কালোয় মেশানো দোয়েল পাখি। আবার গিয়ে বিস্কুট দিতেই সে বেশ তৃপ্তি সহকারে জল আর বিস্কুট খেয়ে চলে গেল। বড় ভাল লাগল। মনে হল আজকের দিনটা বড় সুন্দর। তারপর থেকে অন্য পাখিগুলোর খাওয়া হয়ে গেলে ওই দোয়েল পাখিটার জন্য রোজ খাবার রেখে দিতাম। কেন যেন মনে হত ওই পাখিটা বড্ড লাজুক। বড্ড একা। বড় অল্পে খুশি।
এক একদিন সন্ধেবেলায় কোনও কাজে বাইরে যেতাম। বাড়ির সামনেই একটা বড় বাঁশের ঝাড় আছে। আর আছে একটা বেশ বড় বটগাছ। ওই গাছের তলা দিয়ে পেরোতে গিয়ে থমকে দাঁড়াতাম। কী অজস্র পাখির কলতান। একে অপরের সঙ্গে কত কী যে অনর্গল বলে চলেছে। আমি যদি একটু বুঝতে পারতাম! একদিন রাত্রিবেলায় বারোটা সাড়ে বারোটা হবে। ব্যালকনিতে একটা ঠক ঠক আওয়াজ শুনে বেশ ভয় পেয়ে গেছি। তারপর মনে সাহস এনে অল্প একটু দরজাটা ফাঁক করে দেখি একখানা পেঁচা এসে উপস্থিত। এতদিন জানতাম পেঁচা ছোটখাটো পোকামাকড় ধরে খায়। কিন্তু পেঁচা যে বিস্কুট খায় তা ভাবিনি।
ব্যস্ত মানুষের চোখে প্রকৃতির পরিবর্তন, মিঠে কড়া রোদের লুকোচুরি খেলা হয়তো ধরা পড়ে না। কিন্তু যে বড় একা, বড় সংবেদনশীল, সে জীবনের সমস্তরকম ব্যস্ততাকে দূরে সরিয়ে রেখে তার সবটুকু দিয়ে প্রকৃতিকে অনুভব করে। সময়ের পরিবর্তন তাকে মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। শিশিরের ঝরে পড়ার শব্দ, কালপুরুষের নিঃশব্দ বিচরণ অনুভব করতে করতে, গাছের মাথায় জমাট হয়ে থাকা কুয়াশার মধ্যে নিজের জীবনকে মিশিয়ে দিতে দিতে একসময় কুয়াশার মধ্যেই সে মিশে যায়। শুধু সময়ের অভিজ্ঞান জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে এভাবেই মুদ্রিত হয়ে চলে।
***

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.