সুরের ‘‌সলিলে’‌ প্রতিদিনই অবগাহন করি

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

বাঙালির কাছে প্রেমের গান মানেই একঝলক শীতল বাতাসের মতো, যে হাওয়াতে ফুল গাছে গাছে ফুল ফোটে। আর প্রতিবাদের গানের প্রকাশ হল ঝোড়ো হাওয়ার মতো, যা যে কোনও অন্যায়, অবিচার বা অনাচারকে ঝড়ের মতো উড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু প্রেমের গান যদি ঝোড়ো বাতাসের মতো হয়? প্রেমের গানের মধ্যেও যদি ঝোড়ো হাওয়ার মতো একটা শিহরণ থাকে? তখন তা মনে হয় কথা, সুর এবং নিবেদনে অনন্য হয়ে ওঠে। এই অনন্যতার নামই সলিল চৌধুরি।

সলিল চৌধুরিকে সঠিকভাবে মুল্যায়ন করার মতো দক্ষতা মনে হয় বাংলা তথা ভারতবর্ষে কোনও মানুষেরই নেই, কারণ, আমাদের দেশে তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর যোগ্য মূল্যায়ন হয়নি। তাঁর মতো কবি এবং গীতিকার বাংলা সাহিত্য এবং সঙ্গীতজগতে বিরল তো বটেই ,ভবিষ্যতেও আর দ্বিতীয় কেউ আসবেন কিনা সন্দেহ। আর সুরের জায়গায় তাঁর উচ্চতাটা এমন যে সেই জায়গাটা সকলে নীচ থেকে দেখেই ধন্য হয়ে যায়, পৌঁছনোর কথা বোধহয় ভাবতেই পারে না। সঙ্গীতের যে কোনও শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। প্রথম জীবনে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্যপদ লাভ করে প্রতিবাদী সেই কবি ভারতীয় গণনাট্যসঙ্ঘের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শোনাতেন। লিখতেন অজস্র প্রতিবাদের গান এবং গ্রামবাংলার মানুষের রোজনামচার গীতিকবিতা। সুর লাগাতেন একেবারে রাবীন্দ্রিক প্রভাব মুক্ত হয়েই। এইভাবেই ১৯৪৮ সালে “গাঁয়ের বধু” র সৃষ্টি হয়েছিল যা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উদাত্ত কণ্ঠস্বরে আজও অমলিন হয়ে আছে। নিজের লেখা ছাড়াও সুকান্ত ভট্টাচার্যের কতগুলো গীতিকবিতায় সুরারোপ করেছিলেন সলিলবাবু। “রানার”, “অবাক পৃথিবী”, ‘‌‘‌বিদ্রোহ আজ” বা “ঠিকানা” এইসব গান ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। বা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের “পালকী চলে” র কথাই ধরা যাক। এর পাশাপাশি চলছিল স্বরচিত কবিতা এবং সুরারোপ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়াও শ্যামল মিত্র, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা লতা মঙ্গেশকরদের কণ্ঠে অমরত্ব লাভ করেছিল এক একটা গান।

আর বম্বে গিয়েও সলিল চৌধুরির হাতে একের পর এক ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব। ১৯৫৩ সালে নিজের কাহিনী “রিকশাওয়ালা” অবলম্বনে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার বিমল রায় পরিচালনা করেছিলেন “দো বিঘা জমিন” নামের ছায়াছবিটি, যার সুরারোপ করেছিলেন সলিল চৌধুর। বলিউডে এটাই তাঁর অভিষেক। মান্না দের কণ্ঠে অনবদ্য সেই গান “ধরতী কহে পুকার কে/বীজ বিছালে প্যায়ার কে/মৌসম বিতা যায়” এত বছর পরেও সময়ের আঘাতে একটুও ম্লান হয়নি। তার পরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বিরাজ বৌ, নৌকরি, রিবার, আমানত, ধুমতী, ঝুলা, ছায়া, কাবুলিওয়ালা, মায়া, সপন সুহানে—সুরের সলিলে ভাসছে তখন গোটা বলিউড। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে মধুমতী ছায়াছবির “আজা রে পরদেশী” তো লতাজির ক্যারিয়ারের সেরা পাঁচটি গানের মধ্যে একটি। কাবুলিওয়ালাতে মান্না দের গাওয়া “অ্যায় মেরে প্যায়ারে ওয়াতন” বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া “গঙ্গা আয়ে কাঁহা সে” ভারতবর্ষের আপামর সঙ্গীতপ্রেমীর চিরকালীন সম্পদ। মহম্মদ রফি, মুকেশ, তালাত মাহমুদ, গীতা দত্ত এবং কিশোরকুমার—সলিল চৌধুরি যাঁকে দিয়ে গান রেকর্ড করাচ্ছেন, সর্বদা সোনাই ফলেছে। আর ১৯৭০ সালে হৃষিকেশ মুখার্জির পরিচালনায় সেই অসামান্য ছায়াছবি “আনন্দ” এর গান সব জনপ্রিয়তার রেকর্ড যেন ভেঙে দিল। মুকেশের কণ্ঠে “কহিঁ দূর যব দিন ঢল যায়ে” বা মান্না দের গাওয়া “জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পেহলি” আজও কত নবাগত শিল্পীর বা প্রতিযোগীর ফাংশনে বা প্রতিযোগিতায় গাওয়ার প্রথম পছন্দ।

আসলে, সলিল চৌধুরি গান নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। এতরকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে তাঁর মতো পারঙ্গম সেই সময়ে খুব কম সঙ্গীত শিল্পীই ছিলেন। ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগরাগিনী নিয়ে তাঁর যেমন অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল, তেমনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের জ্ঞানও ছিল অসাধারণ। বাংলা গানে ওয়েস্টার্ন নোটস বা বিটস ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও তিনি পথিকৃৎ। যেমন তরুণ বন্দোপাধ্যায়ের গাওয়া “এসো কাছে এসে বোস/কিছু কথা বলো” বা শ্যামল মিত্রের গাওয়া “যাক যা গেছে তা যাক” বা লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া “বড় শুন্য দিন”-এই গানগুলোতে যেভাবে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সার্থক প্রয়োগ তিনি ঘটিয়েছিলেন, তার তুলনা নেই। তবে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল একই সুরে দুটি বা তার বেশি ভাষায় গান তৈরি করে একাধিক শিল্পীকে দিয়ে সেই একই সুরের বিভিন্ন ভাষার গানকে সুপারহিট করে তোলা। যেমন বাংলায় “গঙ্গা” ছবিতে মান্না দে গেয়েছিলেন “আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে” এই অনবদ্য লোকসঙ্গীতটি। একই সুরে হিন্দিতে “গঙ্গা আয়ে কাঁহা সে/গঙ্গা যায়ে কাঁহা রে” গানটি গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় “কাবুলিওয়ালা” ছায়াছবিতে। দুটো গানই অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আবার এর ঠিক উলটো উদাহরণ ও আছে। বাংলাতে “পাড়ি” ছায়াছবিতে নায়ক ধর্মেন্দ্র এর লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন “বন্ধুরে, কেমন করে মনের কথা কই তারে”। হিন্দিতে “আনোখা মিলন” ছায়াছবিতে সেই ধর্মেন্দ্রর লিপেই গাইলেন কিন্তু মান্না দে একই সুরের হিন্দি গান “বন্ধুরে, ইয়ে মন ডোলে”। এখানেও দুটো গানই সুপারহিট। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন একটা মালয়ালাম ছায়াছবির গানের ক্ষেত্রে। “চেম্মিন” ছায়াছবিতে মান্না দে–‌কে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছিলেন “মানসমায়নে ভরু” যা একসময়ে কেরালা সহ গোটা দক্ষিণভারতের ঘরে ঘরে প্রায় জাতীয় সঙ্গীতের মতোই বেজেছিল। অথচ এই গানটার বাংলা ভার্সানটা কিন্তু গেয়েছিলেন সেই দক্ষিণী শিল্পী জেসুদাস। “শ্রীকান্তের উইল” ছায়াছবির সেই “নাম শকুন্তলা তার” গানটাও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এইভাবে বাংলার শিল্পীকে দিয়ে দক্ষিণী ভাষায় এবং দক্ষিণ ভারতের শিল্পীকে দিয়ে বাংলায় গান করিয়ে দুটো গানই জনপ্রিয়তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া—এটা মনে হয় সলিল চৌধুরি বলেই সম্ভব।

আমাদের ছোটবেলার প্রথম অংশটা শুধু সলিল চৌধুরির গান শুনেই কেটে গেছে। আর একটু পরিণত বয়সে এসে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম তাঁর গণসঙ্গীতে । “ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি/এখানে থেমো না” বা “ঢেউ উঠছে কারা টুটছে” বা ‘‌‘‌এই রোকো রোকো পৃথিবীর গাড়িটা থামাও” বা “পথে এবার নামো সাথী” অথবা “হেই সামালো ধান হো/কাস্তে টা দাও শান হো/জান কবুল আর মান কবুল” তো একটু একটু করে একদিন চেতনায় মিশে গেছে। শোষণ, নিপীড়ন, সন্ত্রাস ও সামাজিক অন্ধকারের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার কলম, তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠ সেই চারের দশক থেকে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অগ্নি উদগার করেছিল। তাঁর মতো বৈপ্লবিক, অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বামপন্থী আন্দোলনের পুরোধা কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের চিরকালীন সম্পদ। বাস্তবিকই ঝড়ের কাছে ঠিকানা রেখে যাওয়া দ্রোহকালের এক কণ্ঠ সলিল চৌধুরি।

আজও আসমুদ্র–‌হিমাচল প্রতিটি সঙ্গীত প্রেমীই সেই “সুরের সলিলে” অবগাহন করেই আলোর পথের যাত্রী।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.