সৃজন শীল
কেউ কেউ থাকেন, যাঁরা সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ভাবেন। তাই সমকাল তাঁদের ঠিকঠাক মূল্যায়ন করতে পারে না। সলিল চৌধুরি তেমনই একজন।
তিনি কতবড় সুরকার, কত বড় মাপের গীতিকার, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এখানে তাঁর অন্য একটি দিক তুলে ধরতে চাই। আটের দশকে তিনি একটা অভিনব উদ্যোগ নিলেন। তিনি ঠিক করলেন, বাংলার বিভিন্ন দিকলাপ লেখকরা নিজেরা নিজেদের গল্প পাঠ করবেন। সেগুলো রেকর্ডে ধরে রাখা হবে। সেই মর্মে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতাবা সিরাজ–সহ আরও অনেকের গল্প রেকর্ড করলেন। ঠিক ছিল, বাংলার বিভিন্ন ক্লাসিক উপন্যাসকেও ক্যাসেটে ধরে রাখবেন।
কবিতা নিয়ে ক্যাসেট হয়েছে। যাত্রা নিয়েও হয়েছে। কিন্তু গল্প নিয়ে ক্যাসেট এই বাংলায় ছিল বলে শোনা যায়নি। কাজটা দারুণভাবে শুরু হয়েছিল। কিন্তু কোনও মহল থেকেই পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাননি। কিছুটা হতাশ হয়েই পিছিয়ে আসতে হয়েছিল। এমন সুন্দর একটা উদ্যোগ মাঝপথেই থামিয়ে দিতে হয়েছিল।
সে ছিল প্রায় চার দশক আগের কথা। এখন ইউটিউব খুললেই অডিও বুকের ছড়াছড়ি। বাংলার ক্লাসিক সাহিত্য থেকে শুরু করে হালফিলের লেখা, প্রায় সবই অডিও বুকে পাওয়া যাচ্ছে। যে যাঁর মতো করে রেকর্ড করছেন। বিভিন্ন পডকাস্ট সংস্থা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনই প্রকাশনা সংস্থাগুলিও নিজেদের মতো করে রেকর্ড করাচ্ছেন। সারা পৃথিবীতেই ছাপা বই আর অডিও বুক যেন হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। অডিও বুকও আস্তে আস্তে সাহিত্যের মূলস্রোত হয়ে উঠছে। অথচ, এই ভাবনাটাই সলিল চৌধুরি ভেবেছিলেন অন্তত চার দশক আগে।
এর থেকেই বোঝা যায়, তিনি কতখানি দূরদর্শী ছিলেন। তাঁর জন্ম শতবর্ষে তাই তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি কিঞ্চিত আত্ম সমালোচনাও জরুরি। সেদিন না বুঝেছিল সরকার, না বুঝেছিল ক্যাসেট কোম্পানি, না বুঝেছিল প্রকাশনা সংস্থা। শোনা যায়, সলিল চৌধুরি তখন পরম আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, অডিও মাধ্যমে সাহিত্য কতটা জনপ্রিয় হতে পারে, এখন কেউ বুঝতে পারছে না। একদিন সবাই বুঝবে। আমি যেটা করতে পারলাম না, একদিন সেই রাস্তায় সবাইকেই হাঁটতে হবে।