প্রশান্ত বসু
কু ঝিকঝিক করে ছুটে চলেছে ট্রেন। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছুটে চলেছে। তারা কখনও ট্রেন দেখেনি। একবার অন্তত ট্রেন দেখতে চায়। কাশবন পেরিয়ে অবশেষে সেই ট্রেন দর্শন। দুজনের চোখেমুখেই কী অদ্ভুত এক মুগ্ধতা।
ছেলেটি কে বা মেয়েটি কে, বাঙালিকে আর বলে দিতে হবে না। বাঙালি জানে, এদের একজন অপু, অন্যজন দুর্গা। এভাবেই বাঙালির মননে অপু–দুর্গার ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল। প্রায় সাত দশক আগের কথা। কিন্তু অপু–দুর্গার সেই ছবি একটুও ম্লান হয়নি।
সেই দুর্গা এবার চলে গেলেন। আমরা যাঁকে দুর্গা বলে চিনেছি, তাঁর আসল নাম ছিল উমা দাশগুপ্ত। কী আশ্চর্য, দুর্গার আরেক নামও তো সেই উমাই। কিন্তু এই উমা দাশগুপ্ত এতদিন কী করছিলেন, আমরা কি জানতাম! অধিকাংশ বাঙালিই তাঁর খোঁজ রাখিনি। আসলে, তিনিও অনেকটা আড়ালেই থাকতে চেয়েছেন।
ভাবা যায়, যিনি পথের পাঁচালির দুর্গা, তিনি ভবিষ্যতে আর কোনও সিনেমাই করেননি! প্রস্তাব আসেনি, এমন নয়। দুর্গা আবার পর্দায় ফিরছেন, এমন জানলে যে কোনও পরিচালকই সাদরে বরণ করে নিতেন। হয়তো তাঁকে কেন্দ্র করেই তৈরি হত চিত্রনাট্য। ঠিক যেমন অপুর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে কৌশিক গাঙ্গুলির অসামান্য ছবি ‘অপুর পাঁচালি’।
কোনও ছবি যেমন করেননি, তেমনই কোনও অনুষ্ঠানেও নাকি যেতে চাইতেন না। পেশাগত জীবনে শিক্ষিকা উমা চেয়েছিলেন, তাঁর ছোটবেলার ছবিটাই বাঙালি মনে রাখুক। বড়বেলায় তিনি দেখতে কেমন, সেই ছবি না দেখানোই ভাল। ভাবতে অবাক লাগে, কী অদ্ভুত সংযম। এই দেখনদারির যুগে মানুষ যখন নিজেদের হাজার হাজার ছবি পোস্ট করে চলেছেন, আর মিনিটে মিনিটে লাইক গুনে চলেছেন, সেখানে উমা দেবী কীভাবে নিজেকে গুটিয়ে রাখলেন! প্রচার ও প্রতিষ্ঠার এত হাতছানি কী হেলায় উপেক্ষা করলেন! সত্যিই, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। দুর্গাদের মৃত্যু নেই। বাঙালি যতই আত্মবিস্মৃত জাতি হোক, সত্তর বছর আগের ছবিটাই সে সযত্নে মনের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখবে।