স্বরূপ গোস্বামী
টেস্ট জেতার কতগুলি চেনা ফর্মুলা ছিল। বিপক্ষের থেকে দুশো রানে এগিয়ে আছো? আর কিচ্ছু ভাবার দরকার নেই। চোখ বন্ধ করে ওদের ফলোঅনে পাঠিয়ে দাও। সেই কাঁপুনিতেই ওরা শেষ। ইনিংস জয়ের জন্য অপেক্ষা করো। যদি ইনিংসে জয় নাও আসলে, বিপক্ষ কত আর করবে! বড়জোর তোমার প্রথম ইনিংসের রানকে ছাপিয়ে আরও পঞ্চাশ–ষাট বেশি। মানে, কষ্ট করে তোমার দুই ব্যাটসম্যানকে আরও একবার নামতে হবে। তারপর দশ উইকেটে বা আট উইকেটে জয়।
মোটামুটি এটাই ছিল চেনা চিত্রনাট্য। কিন্তু একটি জুটি যেন সব হিসেব ওলট–পালট করে দিয়েছিল। ফলোঅনের চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে এসেও যে দাপট নিয়ে ম্যাচ জেতা যায়, ওই একটি জুটিই দেখিয়ে দিয়েছিল। তেইশ বছর কেটে গেছে। কিন্তু ওই জুটির অভিঘাত এখনও কাটেনি। দুশো রানে এগিয়ে থাকলেই ফলোঅনে পাঠিয়ে দাও— এই সহজ ফর্মুলাও যেন জটিল হয়ে গেছে। বরং উল্টো ছবিটাই বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলোঅন করানোর সুযোগ থাকলেও ফলোঅনে পাঠানোর সাহস দেখাচ্ছে না। পাছে কোনও জুটি দাঁড়িয়ে যায়! তার ওপর চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করার ঝুঁকি তো আছেই।
একটি ম্যাচ, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে একটি জুটি, এমন স্থায়ী ছাপ রেখে গেল কীভাবে? কীভাবে টেস্ট ক্রিকেটের মহাকাব্যে ইডেনের সেই টেস্ট এমন কালজয়ী হয়ে উঠল! ভারত–অস্ট্রেলিয়া লড়াই বললেই অতীতের সব লড়াইকে ছাপিয়ে ওই একটি টেস্টের কথাই বারবার কেন ফিরে আসে? স্কোর বোর্ড অনেককিছুই বলে। আবার অনেককিছু বলেও না। সেই টেস্টে ভিভিএস লক্ষ্মণ আর রাহুল দ্রাবিড়ের জুটিতে ঠিক কত রান উঠেছিল? উত্তরটা হল, ৩৭৬। এটা কি কোনও জুটিতে সর্বাধিক রান? একটু রেকর্ড ঘাঁটতে গিয়ে দেখা গেল, একটি জুটিতে সর্বাধিক ৬২৪ রান উঠেছিল কুমার সাঙ্গাকারা আর মাহেলা জয়বর্ধনের জুটিতে। কোথায় ৬২৪ আর কোথায় ৩৭৬! লক্ষ্মণ–রাহুল জুটির রান প্রথম পঁচিশেও আসছে না। এই রানটা রয়েছে সাতাশ নম্বরে। তাহলে নিশ্চয় ভারতীয় জুটিতে সর্বাধিক! সে গুড়েও বালি। সেই ১৯৫৬ তে ভিনু মানকড়–পঙ্কজ রায়ের জুটিতে ৪১৩। সেই জুটির ঘাড়ে জোরালো নিশ্বাস পড়েছিল শেহবাগ–রাহুল জুটির ৪১০। এমনকী পঞ্চম উইকেটের নিরিখে ধরলেও এর থেকে বেশি রান আগেও দু’বার হয়েছে।
অর্থাৎ, রেকর্ড বইয়ের নিরিখে এই জুটির রান সত্যিই তেমন পাতে দেওয়ার মতো নয়। তবু রেকর্ড বইকে তুচ্ছ করে এই জুটি ছিনিয়ে নিয়েছে মহাকাব্যিক জুটির তকমা। আসলে, সেবার টানা ১৬ টেস্ট জয়ী স্টিভ ওয়ার অশ্বমেধের ঘোড়া এসে থেমেছিল ইডেনে। তার ওপর ফলোঅনের পর এমন দুরন্ত কামব্যাকের পটভূমি। অসিদের ৪৪৫ এর জবাবে ভারতের অসহায় ১৭১। লক্ষ্মণ (৫৯) ছাড়া আর কেউ ২৫ এর গন্ডি টপকাতেও পারলেন না। তৃতীয় দিনেই ইনিংস হারের ভ্রুকুটি। প্রথম ইনিংসে ছয় নম্বরে নামা লক্ষ্মণকে তিন নম্বরে তুলে আনা। অগত্যা, এতদিন তিনে নামা রাহুলকে পাঠাতে হল ছয় নম্বরে। সদগোপন রমেশ, শিবসুন্দর দাসরা যেমন ফিরে গেছেন, তেমনই ফিরে গেছেন শচীন তেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি। স্টিভ যেন গব্বরের স্টাইলেই হুঙ্কার ছাড়ছেন, ‘আব তেরা ক্যা হোগা কালিয়া!’
কিন্তু বিনয়ী রাহুল বা অতি ভদ্র লক্ষ্মণ কীই বা বলতে পারতেন! হয়তো মনে মনে বলছিলেন, ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।’ শোলে–তে সেলিম–জাভেদের চিত্রনাট্যে যতটা না চমক ছিল, ব্যাট হাতে তার থেকেও জমকালো চিত্রনাট্য সেদিন লিখেছিলেন লক্ষ্মণ–রাহুল। চতুর্থদিন পুরো ব্যাট করেছিলেন। সারা দিন ধরে হাজার চেষ্টা করেও এই জুটি ভাঙতে পারেনি অসি ব্রিগেড। আর শেষদিনে ‘পাঞ্জাব কা পুত্তর’ হরভজনের বাজিমাত তো ছিলই।
এবার কাট টু ২০২৪। ওয়াংখেড়েতে ভারতকে জিততে গেলে করতে হবে দেড়শোরও কম রান। ভারতের যা ব্যাটিং লাইন আপ, তাতে এটা কোনও টার্গেট! তুড়ি মেরে করে ফেলার কথা। কিন্তু ঘরপোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় হয় বৈকি। টেস্টে ৫৩৬ উইকেট নেওয়া অভিজ্ঞ রবিচন্দ্রন অশ্বিন সাবধানবাণী শোনালেন, ‘যতটা সহজ মনে হচ্ছে, কাজটা মোটেই ততটা সহজ নয়।’ আচ্ছা বেরসিক লোক তো! এই টেস্ট কেউ হারে! এবার টেস্টে ৬১৯ উইকেট নেওয়া অনিল কুম্বলে। তাঁর সতর্কবার্তা, ‘এই রান তুলতে গেলে একটা বড়সড় জুটি চাই।’ হাসালেন কত্তা। এই রান তুলতেও জুটি লাগবে!
এজন্যই বলে, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। অশ্বিন বা কুম্বলের অভিজ্ঞ চোখ যে সিঁদুরে মেঘটা দেখতে পেয়েছিল, বাকিদের চোখে তা ধরা পড়েনি। অশ্বিনের কথা অনুযায়ী, সত্যিই সহজ কাজটা শেষমেশ অধরাই থেকে গেছে। কারণ, কুম্বলের কথা অনুযায়ী, জুটি তৈরি হয়নি। শুধু শেষ টেস্ট নয়, গোটা সিরিজে একবারই কোনও জুটিতে দেড়শো রানের গন্ডি টপকেছিল ভারত। বেঙ্গালুরুতে সরফরাজ খান আর ঋষভ পন্থের জুটিতে ১৭৭।
সুনীল গাভাসকারের পর্যবেক্ষণ, ‘টেস্ট খেলার সেই ধৈর্যটাই নেই। তিন–চারটি বল খেলার পরই অনেকে ভেবে নিচ্ছে, আমরা উইকেটে সেট হয়ে গেছি। চাইলেই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারি।’ অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে এই রোগটা কি সারবে? সারাদিন ধরে কোনও জুটি ব্যাট করে খাদের কিনারা থেকে দলকে ফিরিয়ে আনছে, এমন দশ্য কি দেখা যাবে! লক্ষ্মণ–রাহুল সারাদিন কীভাবে উইকেট আঁকড়ে পড়েছিলেন, সেই ভিডিও যদি দেখতে বলা হয়! নাহ, এত ধৈর্য অন্তত এঁদের নেই। কোন ছবির ভিউয়ার কত হল, কত লাইক পড়ল, এই হিসেব রাখাটা অনেক বেশি জরুরি।