শেষ পাতা যেন শেষ পাতাতেই আটকে গেছে

অরিজিৎ দত্ত

আটের দশক বা নয়ের দশকের কথাই ধরা যাক। তখন খবরের কাগজ হত মূলত আট পাতার। কিন্তু তার মধ্যে খেলার খবর থাকত দু’‌পাতার মতো।

এবার এখনকার সময়ে আসা যাক। এখন কাগজ হয় ষোল পাতার। কখনও আবার কুড়ি পাতার। এই ষোল বা কুড়ি পাতার মধ্যে খেলার জাগয়া কতখানি?‌ বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেটের সময় বরাদ্দ হয়তো একটু বেশি। নইলে, অধিকাংশ কাগজেই গড়পড়তা এক পাতা। ভেতরের পাতা যদিও বা থাকে, হয়তে দেখা যায়, প্রায় আশি শতাংশ বিজ্ঞাপন। অর্থাৎ, খবরের জন্য বরাদ্দ কুড়ি শতাংশ। হঠাৎ, কাগজে খেলার পরিসর এতখানি কমে গেল কেন?‌ ভাবার বিষয়।

এবার আসি টিভির প্রসঙ্গে। বছর কুড়ি আগের কথা। টিভিতে প্রায় সব বাংলা চ্যানেলেই খেলার অনুষ্ঠানকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত। জাতীয় লিগ তো বটেই, কলকাতা লিগও সরাসরি দেখানো হত কোনও মেইনস্ট্রিম চ্যানেলে। আর রাত সাড়ে দশটা নাগাদ সব চ্যানেলেরই নিজস্ব খেলার অনুষ্ঠান থাকত। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই অনুষ্ঠান হত প্রায় আধঘণ্টার। রোজ আধঘণ্টার অনুষ্ঠান!‌ তাও আবার খেলা নিয়ে!‌ এখন বিষয়টা অবাক হওয়ার মতো মনে হলেও তখন কিন্তু এটাই ছিল বাস্তব। একই সময় একাধিক অনুষ্ঠান থাকলে দর্শকরা বিভ্রান্ত হতে পারেন। তাই কোনও চ্যানেল হয়তো দশটায় এগিয়ে এনেছিল। আবার কেউ সময় পিছিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাত এগারোটায়। যাঁরা খেলা ভালবাসেন, তাঁরা রাতের ওই সময়টায় টিভির সামনেই কাটাতেন।

সেই চ্যানেল থেকেও খেলার অনুষ্ঠান কেমন যেন হারিয়ে গেল। এখন মূলস্রোত কোনও নিউজ চ্যানেলেই আলাদা কোনও খেলার স্লট থাকে না। আধঘণ্টা তো দূরের কথা, সারাদিনে দশ মিনিটও খেলার জন্য বরাদ্দ হয় কিনা সন্দেহ। টিভি হোক বা কাগজ, খেলার খবরের পরিসর এত কমে আসছে কেন?‌ চ্যানেলগুলির যেমন ভাবা উচিত, তেমনই ময়দানের কর্তা ও খেলোয়াড়দেরও ভাবা উচিত।

টিভিতে এখন খেলার অনুষ্ঠান বলতে ঠিক কী দেখা যায়?‌ ইডেনে ভারতের ম্যাচ থাকলে বা আইপিএলের খেলা থাকলে হয়তো খেলা শুরুর ঠিক আগে ইডেনের গেট থেকে সরাসরি রিপোর্টারের কয়েক মিনিটের প্রতিবেদন। তাও যত না খেলোয়াড়দের ঘিরে, তার থেকে বেশি শাহরুখ খান এলেন কিনা, হাত নাড়লেন কিনা, তা নিয়ে বেশি। কেউ মারাত্মক কিছু করে দেখালে বড়জোর দুপুরে কোনও বিশেষজ্ঞকে ফোন ইনে ধরা। তিনি হয়তো দু’‌চার লাইন বিশ্লেষণ করলেন। ব্যস, ওখানেই ইতি। সন্ধের পর এই সব খবর আর খুঁজেও পাওয়া যায় না। তখন যাবতীয় আলোচনার পরিসর যেন রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ।

আগে আধঘণ্টার অনুষ্ঠান হত বলেই খেলা কেন্দ্রিক অনেক প্রেস কনফারেন্স বা অনুষ্ঠান হত। এখন যেহেতু প্রচার অনেক কমে গেছে, তাই এইসব অনুষ্ঠানগুলোও কমে গেছে। আধঘণ্টার অনুষ্ঠান থাকলে সারাদিনের অনেক রসদ সংগ্রহ করতে হত। এখন সেই তাগিদ নেই। ফলে, রসদ জোগাড় করার জন্য আগের মতো ছোটাছুটিও নেই। ফলে, অনেক বড় ইভেন্টেও সাংবাদিকদের দেখাই পাওয়া যায় না। উদ্যোক্তারাও হতাশ হয়ে পড়েন।

কাগজের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একইরকম। ক্রিকেট, ফুটবল বৃত্তের বাইরে যেসব খেলাধূলা আছে, যাকে ময়দানি ভাষায় স্মল গেমস বলা হয়, তার কভারেজ অনেকটাই কমে গেছে। একজন বাস্কেট বল খেলোয়াড় বা একজন কবাডি খেলোয়াড়ের সমস্যার কথা আর তেমনভাবে উঠেও আসে না। বক্সিং বা সাঁতারের কথাই বা কতটুকু উঠে আসে!‌ কোনও অনুষ্ঠান হলে উদ্যোক্তারাই প্রেস রিলিজ ও ছবি পাঠিয়ে দেন। চেনা জানা বা যোগাযোগ থাকলে কাগজে দু–‌এক লাইন বেরোয়। কাগজের রিপোর্টাররাও জেনে গেছেন, না গেলেও ছবি চলে আসবে। তাই হয়তো যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেন না। তাছাড়া, শুরুতেই যেটা লিখলাম, জায়গার সঙ্কট। এখন সব খবর এক পাতাতেই ধরাতে হয়। হয়তো সেই কারণে স্থানীয় খবর ততখানি জায়গা পায় না। জায়গা পায় না বলেও রিপোর্টারদের মধ্যে সেই তাগিদ থাকে না।

একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। এখন নাকি মানুষ কাগজ পড়ে না। অভিযোগটা হয়তো আংশিক সত্যি। কিন্তু কাগজের পাতা তো বেড়েছে। আট পাতা থেকে ষোল বা কুড়ি পাতা হয়েছে। আনুপাতিক হারে তো খেলার জন্য চার বা পাঁচ পাতা বরাদ্দ থাকার কথা। সেটা কমতে কমে এক পাতায় নেমে এল কেন?‌ সত্যিই কি মানুষ পড়ছে না বলে খবর কমে যাচ্ছে?‌ নাকি উল্টোটা?‌ আকর্ষণীয় খবর থাকছে না বলে পাঠক আগ্রহ হারাচ্ছেন?‌ তবে এরই মাঝে আকাশবাণীর কথা আলাদা করে বলতে হবে। বাংলায় এবং হিন্দিতে আলাদা করে স্পোর্টস বুলেটিন যেমন থাকে, তেমনই থাকে ফুটবল, ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলার প্রাণবন্ত ধারাভাষ্য। বাংলার ফুটবলকে একসময় বাঙালির রান্নাঘরে পৌঁছে দেওয়ার পেছনে আকাশবাণীর ভূমিকাও কিন্তু কম নয়, বরং অন্যান্য মিডিয়ার তুলনায় অনেকটাই বেশি।

একটা সময় রিপোর্টাররা ময়দানে পড়ে থাকতেন। সকাল থেকে রাত এই তাঁবু, ওই তাঁবুতে খবরের খোঁজে ঘুরে বেড়াতেন। সেই তারুণ্য, সেই তাগিদ তো এখন দেখি না। খেলোয়াড়দের সঙ্গে সাংবাদিকদের যে সম্পর্ক, তাতেও যেন অনেক ভাটা পড়েছে। আগে সাংবাদিকরা খেলোয়াড়দের বাড়িতে যেতেন, অফিসে যেতেন, ক্লাবে আড্ডা দিতে যেতেন। সেখান থেকেই বেরিয়ে আসত কত এক্সক্লুসিভ খবর। এখন এই যাতায়াত ও যোগাযোগ অনেকটাই কমে গেছে। কে কী করছেন, ফেসবুকে দিয়ে দিচ্ছেন। তিনিও ভেবে নিচ্ছেন, সবাই তো দেখেই নিল, তাহলে আর সাংবাদিকের কী দরকার?‌ যাঁর যা জানানোর, ফেসবুকেই জানিয়ে দিচ্ছেন। কাগজ খুললেই দেখা যাচ্ছে, তারকারা ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে যেসব ছবি পোস্ট করছেন, সেগুলোই কাগজে ছাপা হচ্ছে। একটা সময় এই বাংলা কাগজেই কী অসাধারণ সব স্টোরি হয়েছে। গোটা দেশের ক্রিকেট দুনিয়ায় ঝড় তুলে দিয়েছে বাংলার সাংবাদিকদের প্রতিবেদন। বলা হয়, একসময় ক্রিকেট ইন্ডাস্ট্রিকে শাসন করতেন বাংলার রিপোর্টাররা। কিন্তু এখন!‌ জাতীয় স্তরে শেষ কবে বলার মতো এক্সক্লুসিভ হয়েছে, মনে করা কঠিন। মনোজ তেওয়ারি বা ঋদ্ধিমান সাহা অবসর নিলে, সেই খবরও কার্যত ফেসবুক দেখে টুকতে হয়।

কর্পোরেট সংস্থাগুলি আসার ফলেও সাংবাদিকতার অনেক ক্ষতিই হয়েছে। এখন প্রায় সব ক্লাব, সব প্রতিষ্ঠানেই রয়েছেন মিডিয়া ম্যানেজার। তাঁরাই কোচের বক্তব্য হ্যান্ড আউটের আকারে, নইলে ভিডিও–‌র আকারে সাংবাদিকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দিয়ে দিচ্ছেন। ফলে, সাংবাদিক ঘরে বসেই কোচের বাইট বা বিবৃতি পেয়ে যাচ্ছেন। তাঁকেও কষ্ট করতে হচ্ছ না। ছোটাছুটি করতে হচ্ছে না। এদিকে, মিডিয়া ম্যানেজার যে খবর খাওয়াতে চাইছেন, সেটাই কাগজগুলো গিলছে। আলাদা করে কোচ বা খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলার, ভেতরের খবর বের করে আনার সেই তাগিদ নেই। খেলোয়াড়দের কথা বলার ওপরেও নানা বিধিনিষেধ। ফলে, তাঁরাও মুখ খুলছেন না। তাছাড়া, বাঙালি কোচ বা বাঙালি খেলোয়াড় থাকলে যতখানি নৈকট্য গড়ে ওঠে, ভিনদেশি কোচ বা ভিনরাজ্যের ফুটবলারদের নিয়ে কপি লিখলে তার আকর্ষণও অনেকটাই কমে যায়। পিকে ব্যানার্জি, অমল দত্ত বা পরের প্রজন্মের সুভাষ ভৌমিক–‌সুব্রত ভট্টাচার্য থাকলে বড় ম্যাচ যে উচ্চতায় পৌঁছয়, দুই ক্লাবে দুই স্প্যানিশ কোচ থাকলে সেই উত্তাপ কখনই তৈরি হবে না। তিনি বড় ম্যাচের ইতিহাস বা উত্তাপ, কোনওটাই বোঝেন না। গতে বাঁধা কথাই বলবেন। খেলোয়াড়রাও প্রায় তাই। ফলে, এসব দিয়ে কপি জমজমাট চেহারা নেওয়া মুশকিল।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খবরের ক্ষেত্রেও যেন সেই আকর্ষণ থাকছে না। খবরের কাগজ বা টেলিভিশন এখন শুধু সংবাদসংস্থার পাঠানো খবরের ওপর নির্ভরশীল নয়। ইন্টারনেটে দেশ বিদেশের এতরকম ওয়েবসাইট দেখার সুযোগ এসেছে। সারা পৃথিবীর নানা আকর্ষণীয় খবর এখন মুহূর্তে হাতের মুঠোয়। কিন্তু কাগজে যেন তার অক্ষম অনুবাদ। সবই আছে, কিন্তু কিছু যেন নেই। অনুবাদ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা কতটা সাংবাদিক সুলভ আর কতটা কেরানিসুলভ, সেই প্রশ্নও থেকেই যায়। অর্থাৎ ডেস্কের কপিতে যে প্রাণ পাওয়া যেত, তাও যেন রক্তাল্পতায় ভুগছে।

সবমিলিয়ে বাংলা মিডিয়ায় ক্রীড়া সাংবাদিকতা অনেকটাই যেন সংকটে। চ্যানেল বা কাগজে কেন খেলার খবরের পরিসর কমে যাচ্ছে, তা নিয়ে সত্যিই আরও গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। ময়দানের লোকেরাও ভাবুন। মিডিয়ার লোকেরাও ভাবুন। খেলার মাঠই পারে সব সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে নতুন এক পৃথিবীর সন্ধান দিতে। বিশ্বকাপ, ইওরো কাপের হাজার মাইলের মধ্যেও আমরা নেই। তবু আমরা রাত জাগি। মারাদোনা বা পেলের মতো কিংবদন্তিরা মারা গেলে, আমাদেরও চোখ ও মন ভিজে আসে। অলিম্পিকে ভারত যখন সোনা পায়, তখন সেটা শুধু সেই ক্রীড়াবিদের সাফল্য নয়। তামাম দেশবাসী মনে মনে গর্বিত হন। এই গর্বের অনুভূতি তো খেলাই এনে দিতে পারে। বাংলার মিডিয়াই তো আমাদের মনে এই স্বপ্নের জাল বুনেছে। বাংলার মিডিয়াই তো সারা পৃথিবীকে আমাদের চেতনার গভীরে পৌঁছে দিয়েছে। দ্বিধা ও জড়তা ভেঙে আবার একবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠুক বাংলার ক্রীড়া সাংবাদিকতা। আবার সেই গর্বের দিনগুলো ফিরে আসুক। নতুন প্রজন্মের ব্যাটন হাতে ছুটছে একঝাঁক তরুণ তুর্কি। তাদের হাতের মশাল আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠুক।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.