আজি হেমন্ত জাগ্রত দ্বারে

অন্তরা চৌধুরি

অন্য বছর এই সময়টা বাড়িতেই থাকি। দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজোর মাঝখানের এই সময়টা আমার কাছে বড় প্রিয়। বড় আনন্দের। ভ্যাপসা গরম আর বৃষ্টির ভ্রূকুটি কেটে গিয়ে চুপি চুপি শীতের পদধ্বনি শোনা যায়। তাই গরম আর শীতের মধ্যস্থতাকারী কার্তিক বড় ভাল মাস। ভোরের দিকে কেমন যেন একটু শীত শীত ভাব। জানলা খুললেই একরাশ কুয়াশার ঝাপটা লাগে চোখে মুখে। মনে হয় অনেকক্ষণ ধরে উপভোগ করি এই সময়টাকে। ছোটবেলায় ঠাকুমা বলতো কার্তিক নাকি বড় পুণ্য মাস। সারা কার্তিক মাস জুড়ে বিষ্ণু বাতাস বয়। এই সময় ভোরের বাতাস গায়ে লাগাতে হয়। তাতে নাকি অনেক রোগ অসুখ সেরে যায়। সত্যি-মিথ্যের তর্কে যাব না। শুধু এটুকু বলতে পারি এই কার্তিক মাসটা আমার কাছে বড় আনন্দের।

বিজয়ার বিষাদ শেষে একটু একটু করে শরৎ চলে যায়। কাশফুল পরের বছর ‘আবার আসব’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোথায় যেন নিমেষে হারিয়ে যায়। শিউলি ফুল টিকে থাকলেও কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এই কার্তিক মাসের শিউলি মাটিতে ঝরে পড়া পছন্দ করে না। বরং ফুরিয়ে যাওয়ার আগে সে গাছের সঙ্গে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। তাকেও টিকে থাকার লড়াই করতে হয়। হেমন্তের শিউলির মধ্যে শরতের সেই প্রাণ চঞ্চলতা থাকে না। কারণ তার বিদায় নেওয়ার সময় আসন্ন। একটু একটু করে প্রকৃতির বুকে হেমন্ত আসে। সবুজ ধানের ডগায় কখন যেন চুপিসারে হলুদের আভা লেগে যায়। খেজুর বনে ‘শিউলি’দের অর্থাৎ যাঁরা খেজুর গুড় তৈরি করে তাঁদের ব্যস্ততা তখন তুঙ্গে। জঙ্গলের মধ্যে একটা মনের মতো জায়গা পছন্দ করে সেখানেই আস্তানা গাড়ে। খেজুর পাতা দিয়ে ইগলুর আদলে কয়েক মাসের জন্য অস্থায়ী ঘর তৈরি করে। চারপাশটা গোবর দিয়ে নিকিয়ে বেশ ঝকঝকে করে তোলে। পাশেই তৈরি করে দুমুখো চ্যাপ্টা উনুন। আর সেখানে জঙ্গলের ঝরে পড়া সোনাঝুরি গাছের পাতা স্তূপীকৃত করে গুড়ে জ্বাল দেওয়ার জন্য। খেজুর গাছগুলোকে এই সময় কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। ভাল রস না হলে ভাল গুড় হবে না। সারা বছর অবহেলায় পড়ে থাকলেও খেজুর রস আর খেজুর গুড়ের জন্য এই কার্তিক মাস থেকে এদের কদর বেড়ে যায়। পুরনো পাতা কেটেকুটে এদের বেশ ঝকঝকে করে মাথায় হাঁড়ি টাঙিয়ে দেওয়া হয়। প্রকৃতি কী অদ্ভুত তাই না! ভাবতে বসলে বিস্মিত হতে হয়। কে যে প্রথম আবিষ্কার করেছিল কে জানে! ওইরকম রুক্ষ কাঁটাভরা শ্রীহীন একটা গাছ থেকে এমন মন মাতানো রস পাওয়া যাবে, আর তা থেকে এমন সুগন্ধী গুড় তৈরি হবে- কে জানত!

হেমন্তের এই মুহূর্তগুলো বড় মধুর, বড় উপভোগ্য। ভোরবেলায় হাঁটতে বেরোলে পিসিমণি বলে, ‘মাথায় একটা ওড়না ঢাকা দিয়ে যাবি। না হলে শিশির লেগে শরীর খারাপ করবে।’ এখন আমি কর্মসূত্রে প্রবাসী বাঙালি হয়ে গেছি। ভাগলপুর জায়গাটা খারাপ নয়। থাকতে থাকতে সব কিছুই মানিয়ে নিয়েছি। মানিয়ে নিচ্ছি। এবারে দুর্গাপুজোর পর বাড়ি থেকে আসার সময় বড্ড মন খারাপ লাগছিল। বাড়ি থেকে আসার সময় আমি কোনওদিন কাঁদিনি। এমনকী বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময়েও নয়। কিন্তু এবারে কেন জানি না, খুব কষ্ট হচ্ছিল। অনেক কষ্টে চোখের জল মুছে হাসিমুখে সবাইকে ছেড়ে চলে এসেছি। না হলে আমার কান্না দেখে মায়ের কান্না আরও বাড়ত। আমাকে মা বলে, ‘তোর মনটা বড় কঠিন।’ আমি মনে মনে হাসি। সকলের সামনে কাঁদলেই বুঝি মন নরম হয়! কী জানি। মায়ের এই অভিযোগ কোনওদিন মিটবে না। নিজের বাড়ি, নিজের হাতে গড়া সংসার, নিজের প্রিয়জন, প্রিয় শহর, প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্টের মাপকাঠি কি দু ফোঁটা চোখের জল হতে পারে!

বিজয়ার পর বিকেল বেলায় শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছিলাম। রাস্তার দু’পাশে ধান ক্ষেত থেকে আসা নতুন ধানের সুগন্ধ, আর সোনাঝুরি ফুলের হলুদ রেণুতে রাঙানো পথ আর হেমন্তের স্নিগ্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। একটু একটু করে লাজনম্রা বধূর মতো হাতে সাঁঝের প্রদীপ জ্বেলে সন্ধে নেমে আসছিল। একটা একটা করে তারা ফুটে উঠছিল আকাশের গায়ে। আমি টোটোদাদাকে বললাম খুব আস্তে আস্তে টোটো চালাতে। কারণ হেমন্তের বুকে এই সন্ধে নেমে আসার দৃশ্য আমার কাছে বড় মহার্ঘ্য। ছোট ছোট গ্রাম্য জনপদ পেরিয়ে যেতে যেতে দেখি, গ্রামের কাকিমা জেঠিমারা হাতে টোকার মধ্যে প্রদীপ আর ধূপ নিয়ে সন্ধে দিচ্ছে। কাজুবন আর সোনাঝুরির জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া বাঁকুড়া থেকে ছাতনার রাস্তাটা আমার খুব প্রিয়। কেন জানি না মনে হয় একমাত্র এই সময়টাতেই প্রকৃতিকে সবচেয়ে নিবিড় ভাবে উপভোগ করা যায়।

রাত্রিবেলায় সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আমি ছাদে যাই। বিশ্ব চরাচর জুড়ে একাকী জ্যোৎস্নার টুপ টুপ করে ঝরে পড়া দেখি। মহাকালের গর্ভে বিলিন হয়ে যাওয়া শিশিরের শব্দ শুনি। চাঁদের শীতলতা আমাকে আচ্ছন্ন করে, মুগ্ধ করে। ছোটবেলায় ছাদে বাবাইয়ের পাশে শুয়ে যে সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখতাম, আজও তাকে দেখি। শুধু আমার পাশে আজ বাবাই নেই। অথচ সপ্তর্ষিমণ্ডলটা সেই একইরকম আছে। ওর বয়স কত কেউ কি জানে? আমার পরেও কত অনাগত প্রজন্ম এই চাঁদ, এই সপ্তর্ষিমণ্ডল, এই ঝরে পড়া কার্তিকের জ্যোৎস্না দেখে মুগ্ধ হবে। তখন হয়তো পৃথিবীর বুক থেকে আরও একটা মৃত মানুষের চিহ্ন বড় তাড়াতাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

এই সময় ভোরবেলা কিছুতেই বিছানায় শুয়ে থাকতে পারি না। কী এক অদৃশ্য তাড়নায় ঘুম থেকে উঠে যেতে ইচ্ছে করে। উঠে চুপচাপ জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রকৃতিকে দেখি। চারপাশটা ভোরের এক অদ্ভুত সুগন্ধে পরিপূর্ণ থাকে। আলো না ফুটলেও সেই আবছা অন্ধকারে আলোর একটা মৃদু আভাস দেখা যায়। চারপাশটা কী সুন্দর শান্ত, স্নিগ্ধ, শীতল, পবিত্র। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। কোনও কোলাহল নেই। থাকে শুধু এক অপরূপ মুগ্ধতা। ভোরের সেই সুগন্ধ, সেই মুগ্ধতার স্পর্শ যে না পেয়েছে তাকে বোঝানো যাবে না এই ভোরের মাহাত্ম্য। তাই যেদিন ভোরে উঠতে পারি না, সেদিন মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় জীবন থেকে একটা অপরূপ ভোর হারিয়ে গেল।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.