স্নেহা সেন
পুজোয় একসঙ্গে অনেক ছবি মুক্তি পেলে যা হয়! কোনওটাই ঠিকমতো দেখা হয়ে ওঠে না। প্রযোজকরা ভেবে নেন, দর্শকদের আর বুঝি কোনও কাজ নেই। পুজোর ছুটি পেলেই সবাই মণ্ডপে না গিয়ে সিনেমা হলে ভিড় করবেন। কেউ কেউ হয়তো দেখেন। কিন্তু অনেকেরই সেটা হয়ে ওঠে না। আবার লক্ষ্মীপুজোর পর হল থেকে অনেক ছবি হারিয়ে যায়। ফলে, না দেখাই থেকে যায়। মাছ ছয়েক পর হয়তো হইচই বা অন্য কোনও ওয়েব প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাবে। তখন হয়তো দেখা হবে। তবে যাই বলুন, টাটকা হলে গিয়ে দেখা আর বাসি হয়ে যাওয়ার পর মোবাইলে দেখা— এই দুইয়ের মধ্যে অনেক ফারাক।
কিন্তু বছরে হাতে গোনা দশ–বারোটা ভাল মানের বাংলা ছবি হয়। সেগুলো না দেখলে আফশোস থেকেই যায়। নন্দিতা রায়–শিবপ্রসাদ মুখার্জিরা হাজির হন এই পুজোর সময়েই। গতবছর এসেছিল রক্তবীজ। এবার বহুরূপী। পুজোর আগে না হোক, পরে অন্তত দেখা হল। ঠিক কেমন ছবি বহুরূপী? যাঁরা বেলাশেষে বা হামি দেখে আপ্লুত, তাঁদের হয়তো তেমন ভাল নাও লাগতে পারে। আসলে, গতবছর থেকেই পারিবারিক ছবির বদলে কিছুটা থ্রিলারের দিকে ঝুঁকেছেন এই দুই পরিচালক।
ছবির নামেই বোঝা যাচ্ছে, বহুরূপীর জীবন নিয়ে ছবি। তবে আর দশজন চেনা বহুরূপী নয়। এখানে বহুরূপী শব্দটা কিছুটা রূপকধর্মী। গল্পের নায়ক আসলে কে? বহুরূপীর বেশে থাকা শিবপ্রসাদ নাকি পুলিশের ভূমিকায় থাকা আবির চ্যাটার্জি? দুটি চরিত্রকেই যত্ন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। দুটি চরিত্রের মধ্যে লড়াই। কিন্তু দু’জনকেই ভালবাসতে ইচ্ছে করবে। আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দু’জনকেই ঠিক বলে মনে হবে। পাশাপাশি দুই ঘরনি। বহুরূপীর ঘরনি কৌশানি আর আবিরের ঘরনি ঋতাভরী। এই দুটি চরিত্রও বেশ যত্ন নিয়ে বানানো। এই দুই চরিত্রেও অনেকখানি আলো পড়েছে।
গল্পের নির্যাস মোটামুটি এরকম। চরিত্রের নামগুলো বললে গুটিয়ে যেতে পারে। তার থেকে অভিনেতার নাম উল্লেখ করে বললে বুঝতে কিছুটা সুবিধা হয়। জুট মিলের শ্রমিক শিবপ্রসাদ। কিন্তু একটি খুনের মামলায় অকারণেই তার নাম এসে যায়। সবাই তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়। শেষমেশ জেল যেতে হয়। পুলিশের বেশে থাকা আবির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না থাকলেও আসামী পেট থেকে কথা বের করতে পুলিশ যা করে থাকে, সেই নির্যাতন করে যায়। শিবপ্রসাদ নিজেকে নির্দোষ বলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর কথা কেউ শুনলে তো! বাকি সব সাক্ষীই যে তাঁর বিপক্ষে। ফলে, জেলযাত্রা। এদিকে জেলে গিয়ে শিবপ্রসাদ সন্ধান পায় এক গুরুর। সেই গুরু শেখায় কীভাবে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে হয়। ভয় দেখিয়ে নয়, ভালবেসে ডাকাতি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে শিবপ্রসাদ আশ্রয় নেয় এক বহুরূপীদের গ্রামে। সেখানে সবাই চোর, সবাই বহুরূপী। নিজের মতো করে দল তৈরি করে। ঠিক করে সেই পুলিশ অফিসারের (আবির) এলাকাতেই ডাকাতি করবে। একের পর এক নিখুঁত হোমওয়ার্ক। তারপর চারজনের ছোট্ট টিম নিয়ে ডাকাতি। বড় ভালবেসে করা সেই ডাকাতি। হাতে খেলনা বন্দুক। কাউকে মারধর করার ব্যাপার নেই। তেমন ভয় দেখানোরও ব্যাপার নেই। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার নিজেই যেন ডাকাতদের ফ্যান হয়ে পড়ছেন। অভিযোগ জানানোর বদলে ঝরে পড়ছে একরাশ মুগ্ধতা।
এদিকে, যাঁর এলাকায় এত এত নিঃশব্দ ডাকাতি হয়ে চলেছে, তাঁর অবস্থাটা ভাবুন। কখনও ওপরওয়ালার ধমক। কখনও সেই ভদ্রলোক ডাকাতদের ভালবাসা মাখানো ফোন। তাঁকে বোকা বানিয়ে ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে! অপরাধী হাতের কাছেই, কিন্তু ধরা যাচ্ছে না! এদিকে, পারিবারিক জীবনেও নানা ঝড়ঝাপ্টা। তার মাঝেও কী ডাকাতের জীবনে, কী পুলিশের জীবনে, বড় অদ্ভুত একটা দাম্পত্যের পরিসর আছে। ভালবাসায় মোড়া সেই জীবনও অন্য এক আঙ্গিক এনে দেয়। শেষমেশ কী হল সেই ডাকাত দলের? পুলিশ অফিসার কি রহস্যের কিনারা করতে পারলেন? সেসব কথা না হয় হলে গিয়েই জানবেন। কথায় আছে, শেষটা বলতে নেই।
তাহলে ছবিটা কেমন দাঁড়াল? চোর–পুলিশ খেলা আছে ঠিকই, বুদ্ধির ছাপ আছে, এটাও ঠিক। কিছু গভীর বার্তা যেমন আছে, তেমনই হাততালি পাওয়ার ডায়লগও আছে। জোর করে উত্তর মেলানোর গোঁজামেলও আছে। বেশি মশলা মেশাতে গিয়ে আইটেম সং বা অতিনাটকীয়তাও আছে। তবে শিবু–নন্দিতা ঘরানার কাছে মানুষের প্রত্যাশা একটু অন্যরকম। যাঁরা গোত্র বা বেলাশেষের দর্শক, যাঁরা হামি বা পোস্তর দর্শক, তাঁদের এই থ্রিলার হজম নাও হতে পারে। সবরকম ছবি করে বৈচিত্র্য আনতে গিয়ে নিজেদের ঘরানা থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন না তো! পারিবারিক ছবির একটা আলাদা দর্শক আছে। তাঁদের ঢিসুম–ঢাসুমে নাইবা টেনে আনলেন। সবরকম ছবি করতে হবে, কেউ তো এমন মাথার দিব্যি দেয়নি। রাহুল দ্রাবিড় আইপিএলে কী পারফর্ম করেছেন, সেটা অনেকেরই মনে নেই। তবু রাহুল দ্রাবিড় বললেই সম্ভ্রমে মাথা ঝুঁকে আসে কেন? তেমনই এই জুটির সঙ্গে থ্রিলার বিষয়টা সেভাবে যায় না। হজম করতে কষ্টই হয়। অনেকদিনের চেষ্টায় তাঁরা একটা ঘরানা তৈরি করেছেন। বাংলার দর্শক সেই ঘরানাকে, সেই জুটিকে আপন করে নিয়েছে। অন্য জুতোয় অহেতুক পা গলাতে গিয়ে সেই ঘরানাটা হারিয়ে যাক, এটাই বা কী করে চাই? ছবি হয়তো সফল হবে। বক্স অফিসে বাণিজ্যও হবে। কিন্তু সেই বাণিজ্যের অঙ্ক যেন বিপথগামী না করে। শিবু–নন্দিতার কাছে একটাই অনুরোধ, নিজেদের ঘরানাটা হারিয়ে ফেলবেন না। বহুরূপী বা রক্তবীজের জন্য নয়, দর্শক আপনাদের মনে রাখবেন রামধনু, বেলাশেষে বা গোত্র–র জন্যই।