সব ব্যাটাকে ছেড়ে ইউটিউবারকে ধর

রক্তিম মিত্র

একে একে সামনে আসছে। বিভিন্ন ইউটিউবারদের নামে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রত্যন্ত থানায় হচ্ছে এফ আই আর। এটা অবশ্য নতুন নয়, বেশ কয়েক বছর ধরেই এই খেলাটা চলে আসছে। কারও বিরুদ্ধে এফআইআর হচ্ছে পুরুলিয়ায়, তো কারও বিরুদ্ধে কোচবিহার তুফানগঞ্জে। কারো নামে এফআইআর নদীয়ার কোতোয়ালিতে, তো কারও নামে আবার হুগলির কামারপুকুরে। মোদ্দা কথা হল, শাসকের বিরুদ্ধে কথা বললেই তোমার নামে থানায় অভিযোগ জমা পড়বে। আর পুলিশও প্রবল উৎসাহে নোটিশ পাঠাবে।

তারপর কলকাতার ইউটিউবারকে হাজিরা দিতে ছুটতে হবে কখনও নদীয়া, কখনও কোচবিহারে। পুলিশ একবারও তদন্ত করে দেখবে না সেই অভিযোগের সারবত্তা কতখানি। বা যিনি অভিযোগ করছেন, তিনি আদৌ ওই বিষয়টা বোঝেন কিনা। যিনি অভিযোগ করছেন, তিনি আদৌ অভিযোগকারীকে চেনেন কিনা।
আসলে এই অভিযোগকারীরা কেউ নয়। অনেকেই পাড়ার ছেনো মস্তান। ওই অভিযোগ পত্র লেখা তো দূরের কথা, রিডিং পড়তে বললে ঠিকঠাক রিডিং পড়তেও পারবেন কিনা সন্দেহ। তাঁরা এলাকার পরিচিত তৃণমূলি মস্তান। অথচ তাঁদের কথার কত গুরুত্ব। তাঁদের নামে একটা এফআইআর জমা হচ্ছে। আর অমনি পুলিশ তলব করছে সারা বাংলার পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকদের। তারপর থানায় হাজিরা দাও, পুলিশের নানা উল্টোপাল্টা প্রশ্নের জবাব দাও, কেন সরকার বিরোধী লেখা হচ্ছে বা কেন সরকার বিরোধী মন্তব্য করা হচ্ছে, এই নিয়ে কার্যত প্রশাসনিক শাসানি। কখনও ইউটিউবাররা যাচ্ছেন হাইকোর্টে, হাইকোর্ট পুলিশকে মৃদু তিরস্কার করছে। কিন্তু তাতে শিক্ষা বা লজ্জা হবে, এমন আত্মমর্যাদা বোধ অন্তত এই রাজ্যের পুলিশের নেই। কর্মীদের যদিও থাকে, কর্তাদের তো একেবারেই নেই।

দন্তবিগলিত এইসব কর্তারা ধরে আনতে বললে কার্যটা বেঁধে আনেন। তাই আদালত কি বলল তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। কারণ, তাঁরাও জানেন আদালত একটু তিরষ্কার করবে, একটু গ্যালারি শো করবে, এর বেশি দূর আদালত এগোবে না। অন্তত তাঁদের সাসপেন্ড হওয়ার বা চাকরি যাওয়ার কোনও ভয় নেই। বরং এই ইউটিউবারদের শায়েস্তা করতে পারলে, ভয় দেখিয়ে তাঁদের কণ্ঠ রোধ করতে পারলে, শাসকের গুডবুকে থাকা যাবে। আর শাসকের গুডবুকে থাকলে তার কী কী সুবিধে, এই পুলিশকর্তারা বিলক্ষণ জানেন। আদালতের আত্মসমীক্ষা করা উচিত, কেন বিচারপতিরা তিরষ্কারের পরেও পুলিশ দিনের পর দিন সেই একই কাজ করে চলেছে। অর্থাৎ বিচারপতি তিরষ্কারের বা আদালতের ভর্ৎসনার কোনও গুরুত্বই নেই। এতে কি আদালতের সম্মান বাড়ছে? এতে কি বিচারপতিদের সম্মান বাড়ছে?

এবার পুলিশ কর্তারা ভাবুন। শাসকদলকে বা শাসক দলের নেতাদের খুশি করছেন, ভাল কথা। পাড়ার কোনও পুঁচকে মস্তান এফআইআর করল, আর অমনি কলকাতার সাংবাদিকদের তলব করে বসলেন, এর থেকে কি প্রমাণ হচ্ছে? আপনারা ভাবছেন আপনি হয়তো সেই ইউটিউবারকে চমকাচ্ছেন? হয়তো এটা ভেবে কিঞ্চিত শ্লাঘাও অনুভব করছেন। কিন্তু একবারও ভেবে দেখেছেন কি সেই পুঁচকে মস্তানরা আপনাদের কী চোখে দেখে? সেই পুঁচকে মস্তানের কাছে এই বার্তাটাই যাচ্ছে যে, তাঁরা অভিযোগ করলে আপনি কলকাতা থেকে সাংবাদিকদের ডেকে পাঠাবেন। দিনের শেষে কোথাও গিয়ে সেই ছেনো মস্তান বুঝছে যে আপনি আসলে তাঁরও আজ্ঞাবহ। সে বুঝছে, আপনার গুরুত্ব বা আপনার ক্ষমতা তার থেকেও কম। এটা আপনার পক্ষে খুব সম্মানের? তাই যে ওসি বা নানা নামের আশ্রয় থাকা অফিসাররা সাংবাদিকদের ডেকে পাঠাচ্ছেন, তাঁরা ভেবে দেখুন তাঁরা কার হাতের ক্রীড়ানক হয়ে উঠছেন? সরকারের অনেক কাজ। পুলিশের সামনে অনেক কাজ। এসব ছেঁদো কাজে নিজেদের সময় নষ্ট না করে নিজেদের হারানো সম্মান পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করুন। কোনও চ্যানেলে কে কী বললেন, তাঁদের পেছনে না ধাওয়া করে, আসল অপরাধীদের চিনতে শিখুন। আপনাদের সম্মানহানির জন্য আপনাদের কর্তারাই যথেষ্ট। বাইরে থেকে অন্য কাউকে দরকার নেই।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.