প্রশান্ত বসু
একদিনের ক্রিকেট বলতে ঠিক কত ওভারের ক্রিকেটকে বোঝায়? এক মুহূর্তেই সবাই বলে বসবেন, পঞ্চাশ–পঞ্চাশ মিলিয়ে দিনে একশো ওভার। অথচ, ভারত কিন্তু প্রথম যে একদিনের ম্যাচ খেলেছিল, সেআ ছিল ৫৫ ওভারের। না ৫০, না ৬০। ঠিক মাঝামাঝি, ৫৫।
দেখতে দেখতে তার পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। সালটা ছিল ১৯৭৪। অজিত ওয়াদেকারের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম একদিনের ম্যাচ খেলেছিল ভারত। সেই ম্যাচে ভারত হেরেছিল ঠিকই, কিন্তু অধিনায়ক ওয়াদেকার ব্যাট হাতে করেছিলেন ৮২ বলে ৬৭। ব্রিজেশ প্যাটেল করেছিলেন ৭৮ বলে ৮২। অর্থাৎ, স্ট্রাইক রেট একশোর বেশি। পঞ্চাশ বছর পরেও যদি এই পরিসংখ্যানে চোখ বোলানো হয়, নিতান্ত বেমানান মনে হবে না।
ঠিক পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৭৫ এ প্রথম বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে ভারতের অধিনায়ক বেঙ্কটরাঘবন (এমনকী, চার বছর পর, ১৯৭৯ এর বিশ্বকাপেও নেতৃত্বে বেঙ্কট)। প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে গাভাসকার কত রান করেছিলেন? মন্থর ব্যাটিংয়েরর প্রসঙ্গ উঠলে ওই ইনিংসটির কথা টেনে আনা হয়। সেবার বিশ্বকাপ হয়েছিল ৬০ ওভারের। গাভাসকার শুরুতে ব্যাট করতে নেমে একেবারে শেষে অপরাজিত অবস্থায় মাঠ ছাড়েন। নিশ্চয় শতরান পেরিয়ে গিয়েছিলেন? একেবারেই না। ষাট ওভার শেষে তাঁর স্কোর ছিল অপরাজিত ৩৬।
একদিনের ক্রিকেটের পঞ্চাশ বছরে কয়েকটি অন্যরকম পরিসংখ্যান তুলে ধরা যাক। যেমন, প্রথম তিনই বিশ্বকাপই হয়েছিল ষাট ওভারের। তাহলে বিশ্বকাপে পঞ্চাশ ওভার হল কখন থেকে? সাতাশির বিশ্বকাপে। সেবার ভারত ছিল আয়োজক। ভারতে খুব বেশি সময় সূ্যের আলো থাকে না। ৬০–৬০ মিলিয়ে ১২০ ওভার হওয়া মুশকিল। তাই মুশকিল আসান হয়ে এসেছিল ৫০–৫০ ফর্মুলা। যদিও তার আগে অন্যান্য কিছু টুর্নামেন্টে বা দ্বিপাক্ষিক সিরিজে ৫০ ওভারের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে।
আচ্ছা, ভারত প্রথমবার না হয় ১৯৭৪ এ একদিনের ক্রিকেট খেলল। কিন্তু দেশের মাটিতে কখন প্রথম খেলেছিল? অন্তত সাত বছর পর। ১৯৭৫ ও ১৯৭৯— দুটো বিশ্বকাপ ভারত খেলে ফেলেছে। কিন্তু তখনও কিনা দেশের মাটিতে ভারত একটিও ম্যাচ খেলেনি! তথ্যটা অবাক করার মতোই। আসলে, ক্রিকেট বোর্ডের কাছে তখনও একদিনের ক্রিকেটের কোনও গুরুত্বই ছিল না। তাই তাঁরা আয়োজন করার কথাই ভাবেননি।
ছবিটা বদলে দিল শুধু তিরাশির পচিশে জুন। লর্ডসের সেই ঐতিহাসিক ফাইনালই যেন ছবিটা বদলে দিল। একদিনের ক্রিকেটই হয়ে উঠল মূলস্রোত। তার জনপ্রিয়তার কাছে যেন ঢাকা পড়ে গেল সাবেকি টেস্ট ক্রিকেট।
বিশ্বকাপ জয়ের চার বছরের মাথায় কিনা ভারতই বিশ্বকাপের আয়োজক। আর সেই আযোজন করতে গিয়ে কত অঙ্ক, কত কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। তখন থেকে যেন ক্রিকেটের ভরকেন্দ্রটাই বদলে গেল। ইংল্যান্ড নয়, বিশ্বক্রিকেটের চালিকাশক্তি হয়ে উঠল ভারত। একবার নয়, দুবার নয়। চারবার বিশ্বকাপের আয়োজক ভারত। অথচ, ইংল্যান্ড! সেই তিরাশির পর শিঁকে ছিড়েছিল ২০১৯ সালে। অথচ, তার মাঝে ভারতে বিশ্বকাপ হয়ে গেছে ৮৭, ৯৬, ২০১১ তে। এমনকী, গত বছরের বিশ্বকাপ কিনা ভারত এককভাবে আয়োজন করেছে। ৮৩–র পরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ২০১১ তে। আবার ২০০৩ এর পর রানার্স হয়েছে ২০২৩ এ।
টেস্টের জনপ্রিয়তায় থাবা বসিয়েছিল একদিনের ক্রিকেট। ঠিক তেমনই, একদিনের ক্রিকেএর জনপ্রিয়তায় থাবা বসিয়েছে টি২০। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, আইপিএল। ক্রিকেট বাণিজ্যে ভারত বহু বছর ধরেই সবার থেকে এগিয়ে। আর এই আইপিএল আসার পর যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ক্রিকেট আজ কতটা খেলা আর কতটা বাণিজ্য, তা নিয়ে জোর তর্ক হতেই পারে। আইপিএল চললে সারা বিশ্বের ক্রিকেট যেন থমকে যায়। হ্যাঁ, এটাই বাস্তবতা।
তাই বলে কি একদিনের ক্রিকেটে আরতের পথ চলার পঞ্চাশ বছরকে ভুলে যাওয়া যায়! টেস্টের যতই ঐতিহ্য থাক, যতই দীর্ঘ পথ চলার ইতিহাস থাক, কিন্তু ভারতকে পায়ের তলার শক্ত মাটি দিয়েছে একদিনের ক্রিকেটই।