স্বরূপ গোস্বামী
মহম্মদ হাবিবের কি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ছিল? নিশ্চিতভাবেই ছিল না। টুইটার বা ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট? এক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে বলা যায়, এগুলোর হয়ত নামই শোনেননি। ইদানীং, একটা ট্রেন্ড হয়েছে, মোটামুটি একটু সেলিব্রিটি গোছের কেউ হলেই, তাঁর একটা ফ্যান ক্লাব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অহরহ সেই ফ্যান ক্লাবের মোড়কে আত্মপ্রচার চলছে। এসব না করলে নাকি লোকে ভুলে যায়। এসব না করলে নাকি সেলিব্রিটি তকমা থাকে না। না, মহম্মদ হাবিবের এসব কিছুই ছিল না। দরকারও পড়েনি।
নিজের প্রিয় দশ নম্বর জার্সি আর বুট তুলে রেখেছেন তাও প্রায় চার দশক আগে। ফিরে গেছেন নিজের শহর হায়দরাবাদে। তারপরেও ময়দানে শুধু একবার ‘বড়ে মিঞা’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করুন। এক সেকেন্ডের মধ্যে একটা নামই উঠে আসবে, মহম্মদ হাবিব। ‘আত্মবিস্মৃত’ জাতি হিসেবে বিশেষ ‘সুনাম’ অর্জন করেছে বাঙালি। কিন্তু তারপরেও মহম্মদ হাবিবকে ভুলে যায়নি এই শহর। স্বাধীনতা দিবসের দিন অনেকের কাছেই নিছক ছুটির দিন। এই দিনটায় খবরের দুনিয়া থেকে সবাই সাধারণত দূরে দূরেই থাকে। মাঝে একটা সিএল ম্যানেজ করে চারদিনের লম্বা ছুটিতে কেউ দিঘায়, কেউ পুরীতে, কেউ বা অন্য ঠিকানায়। কিন্তু সেই সন্ধ্যাতেও নিমেশে ছড়িয়ে গেল ‘বড়ে মিঞা’র মৃত্যু সংবাদ। সমুদ্র সৈকত থেকেই যে যাঁর মতো দু’লাইন, চার লাইন লিখেও ফেললেন।
সত্যিই তো, কী ছিল মহম্মদ হাবিবের মধ্যে, যার মায়াজাল চার দশক পরেও বাঙালি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এমন কিছু ছিল, যা হয়ত বাকিদের মধ্যে ছিল না। এই বাঙালি দিকপাল ফুটবলার কম দেখেনি। শৈলেন মান্না, চুনী গোস্বামী, পিকে ব্যানার্জি। সাতের দশকে সুভাষ ভৌমিক, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, সুব্রত ভট্টাচার্য, সুধীর কর্মকার, প্রসূন ব্যানার্জি, গৌতম সরকার। কাকে ছেড়ে কার কথা বলবেন! এঁদের খেলা দেখতেও ময়দান উপচে পড়ত। কিন্তু সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও বলতে হয়, হাবিব লাজবাব। তিনি শুধু বুঝতেন, ভাল খেলতে হবে, দলকে জেতাতে হবে। এর বাইরে কিছু বোঝেননি, বুঝতেও চাননি।
বুঝতেন, ভাল খেলতে গেলে প্র্যাকটিসে ফাঁকি দিলে চলবে না। তাই আসতেন সবার আগে, ফিরতেন সবার পর। বুঝতেন, মাঠে জান লড়িয়ে দিতে হবে। বুঝতেন, সন্ধের পর এখান–ওখান আড্ডা নয়, রেস্তোরাঁ বা পানশালা নয়, অনুষ্ঠান বা সংবর্ধনা নয়, সোজা মেসে ফিরতে হবে। সময়মতো ঘুমিয়ে পড়তে হবে, তবেই সময়মতো ওঠা যাবে। এই ছোট ছোট কতগুলি বিষয় বুঝতেন, যা হয়ত অন্যরা সেভাবে বুঝতেন না।
বুঝতেন, চাকরি নিলে বাকি জীবনের সুরক্ষা হয়ত থাকবে, কিন্তু ফুটবলটা খেলা হবে না। তাই চাকরির দিকে পাও মাড়াননি। হ্যাঁ, তিনিই এই বিশাল দেশের প্রথম পেশাদার ফুটবলার। অথচ, এত বড়মাপের এই তথ্যটা আদৌ তিনি নিজে জানতেন কিনা, বলা মুশকিল। পেশাদারিত্ব মানে টাকা নেওয়া নয়, বিনিময়ে দ্বিগুন ফিরিয়ে দেওয়া। পেলের বিরুদ্ধে খেলা। যে কোনও খেলোয়াড়ের জীবনেই স্বপ্ন। ছবি তুলে রাখার মতোই মুহূর্ত। স্মৃতির ঢেঁকুর তোলার মতোই গর্বের বিষয়। যাঁরা খেলেছেন, সবাইকেই অহরহ এই স্মৃতির ঢেঁকুর তুলতে হয়। সবার বাড়ির ড্রয়িংরুমেই পেল্লাই সাইজের ছবিটা বাঁধানো। একমাত্র একজনের বাড়িতেই এই ছবি নেই। তিনি মহম্মদ হাবিব। শোনা যায়, ম্যাচ শুরুর আগে সবাই পেলের পাশে যাওয়ার জন্য, ছবি তোলার জন্য অস্থির। প্রায় সবাই অকপটে সেকথা স্বীকারও করেছেন। কিন্তু একজন হাত মেলাতে যাননি। বলেছিলেন, ‘পেলেও প্লেয়ার আছে, আমরাও প্লেয়ার আছি। যো হোগা, ম্যাচকে বাদ।’ এই মস্তানিটা একজনকেই মানায়, মহম্মদ হাবিব। সেই ম্যাচের অধিনায়ককে দিয়েছিলেন এক ধমক, ‘বারবার উধার কিঁউ দেখতা হ্যায়। বল কি তরফ দেখ।’ সেদিনের সেই অধিনায়কের নাম সুব্রত ভট্টাচার্য। এই তো সেদিন, এই সুব্রত ভট্টাচার্যের আত্মজীবনী বেরোলো। উৎসর্গ কাকে করলেন? সেদিনের ধমক দেওয়া সেই হাবিবকেই।
আচ্ছা, হাবিবের ফোনে কোনও সাংবাদিকের নম্বর সেভ করা ছিল? নিজে থেকে কখনও কোনও সাংবাদিককে ফোন করেছেন? এই উত্তরটাও সম্ভবত ‘না’। আটের দশকের শুরুতে। একটি বিখ্যাত পত্রিকায় তাঁর আত্মজীবনী বেরোবে। মানে, তিনি বলে যাবেন, অন্য কেউ সাজিয়ে গুছিয়ে সেটা লিখবেন। সেই সাংবাদিক হায়দবারাদে পৌঁছে গেলেন। দিন সাতেকের জন্য হোটেলও বুক করে ফেললেন। অন্তত পাঁচদিন হাবিবের বাড়িতে গেলেন। তারপর সেই সাংবাদিকের উপলব্ধি, পাঁচদিনে যা বলেছেন, তা দিয়ে একটা প্যারাগ্রাফ লেখাও মুশকিল। প্রথমত, আত্মজীবনী কী, সেটাই বোঝেন না। নিজে থেকে কিছুই প্রায় বলেন না। অনেক খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেও উত্তর আসছে বড়জোর এক লাইন। পেলের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা! অন্য যে কেউ হলে শুধু এটা নিয়েই ঘণ্টা দুয়েক বলে যেতেন। তিনি বললেন, ‘হাঁ, পেলে আয়াথা। আচ্ছা প্লেয়ার থা।’ এখানেই শেষ। তিন বড় ক্লাবে খেলেছেন আঠারো বছর। এত ট্রফি, এত স্মৃতি। কিছুই মনে রাখেননি, ‘যো বিত গ্যায়া, বিত গ্যায়া। উনকো ছোড়ো।’
কিন্তু ফিরে এসে সেই সাংবাদিককে তো কিছু লিখতে হবে। তিনি যা হোক, এর–ওর কাছ থেকে শুনে, লেখাটা কোনওরকমে দাঁড় করালেন। কিন্তু যাঁর জীবনী লেখা হল, তিনি পড়েও দেখেননি। সাতদিন থেকে লোকটা ফিরে গিয়ে কী লিখল, জানার চেষ্টাও করেননি। পৃথিবীর সম্ভবত একমাত্র মানুষ যিনি জানেনও না, তাঁর আত্মজীবনীতে কী লেখা হয়েছে।
কয়েকটা অতীতের প্রসঙ্গ টেনে আনলে হয়ত বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তবু টানা যাক। মহেন্দ্র গুপ্ত ‘কথামৃত’তে কী লিখেছেন, অনেকটাই জানতেন মা সারদা। মাইকেল তাঁকে নিয়ে কী কবিতা লিখেছিলেন, বিলক্ষণ জানতেন বিদ্যাসাগর। রূপ–সনাতন কী পদ লিখছেন, চৈতন্য মহাপ্রভুও নিশ্চিতভাবেই জানতেন। লুই ফিশার কী লিখছেন, মহাত্মা গান্ধীর মতো মানুষও জানতেন। মহম্মদ হাবিব জানতেন না, কোথায় তাঁকে নিয়ে কী লেখা হচ্ছে। এমন একজন বিরল মানুষকে শুধুই ‘লড়াকু ফুটবলার’ বলবেন! এমন একজন মানুষ এই ভারতবর্ষে এতদিন ছিলেন, এটা ভেবে বিস্মিত হবেন না!
(ময়দানের বড়ে মিয়াঁ মহম্মদ হাবিবের মৃত্যুর একবছর। তাঁর মৃত্যুর সময়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বেঙ্গল টাইমসের ই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল একটি লেখা। এক বছর পর ফিরে দেখা। সেই লেখা আবার ফিরিয়ে আনা হল।)