রক্তিম মিত্র
কোনও একটা অপকর্ম হলেই হল। কেউ কেউ অমনি প্রশ্ন তুলে দেন, বুদ্ধিজীবীরা কোথায় গেলেন? কারও কারও একেবারে স্পেসিফিক প্রশ্ন, কোথায় গেলেন অপর্ণা সেন, কৌশিক সেনরা?
যথারীতি আরজি করের নৃশংস ঘটনার পরেও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু সেই তাঁরাই। ভাবখানা এমন, যেন তাঁরাই এসবের জন্য দায়ী। অপর্ণা সেন আরজি করে গেলেন। কেউ কেউ গো ব্যাক আওয়াজ তুললেন। কেউ কেউ চটিচাটা দূর হটো বলে স্লোগানও তুললেন। ভাবলেন, বিরাট এক বিপ্লব করে ফেলেছেন। কৌশিক সেন, ঋদ্ধি সেনরা গেলেন। সমাজমাধ্যমে নানা বক্রোক্তি ভেসে এল। যেন, প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁরা বিরাট কোনও অন্যায় করেছেন।
বারবার এই দুটো নাম কেন যে উঠে আসে, বুঝি না। এই বাংলায় সরকারে দাক্ষিণ্যভোগী, নির্লজ্জ তোষামোদকারী বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই। চাইলে, এমন পঁচিশ–তিরিশটা নাম করাই যায়। কিন্তু কেন বারবার অপর্ণা সেন আর কৌশিক সেনের নামটা ভেসে ওঠে? যাঁরা এই দু’জনের নাম টেনে আনেন, তাঁরা সচেতনভাবেই আনেন? নাকি এই দুটো নামই প্রথমে মনে পড়ে যায়!
হ্যাঁ, সিঙ্গুর–নন্দীগ্রাম পর্বে প্রতিবাদের অন্যতম মুখ ছিলেন কৌশিক সেন। সোচ্চার ছিলেন অপর্ণাও। বিভিন্ন সভাসমিতিতে, টিভির বিতর্কসভায় তাঁরা বাম সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। এমনকী পরিবর্তন চাই বলে আওয়াজও তুলেছিলেন।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই বিধায়ক, সাংসদ হয়ে গেলেন। অনেকেই অনেক কমিটির মাথা হয়ে বসে গেলেন। দলীয় অনুষ্ঠানের মঞ্চ আলো করলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বরাত পেলেন। সেই তালিকায় কি আদৌ রাখা যায় অপর্ণা সেন বা কৌশিক সেনকে? মনে করে দেখুন তো, তৃণমূলের কোন মঞ্চে তাঁদের দেখেছেন? মনে করে দেখুন তো, তাঁদের কোন কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে? মনে করে দেখুন তো, মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দন্ত বিগলিত করে তাঁরা কোনওদিন ছবি তুলেছেন কিনা। মনে করে দেখুন তো, তৃণমূলের বা শাসকের কোন অন্যায়টাকে জাস্টিফাই করার জন্য তাঁরা মিছিলে হেঁটেছেন?
বরং উল্টোটা বারবার হয়েছে। কৌশিক সেনকে বছরের পর বছর অ্যাকাডেমি দেওয়া হয়নি। শনি–রবিবার কোনও নাটকের শো দেওয়া হয়নি। শাসক নিয়ন্ত্রিত বা শাসকদল নিয়ন্ত্রিত কোনও কল শো–তে তাঁদের ডাকা হয়নি। বাধ্য হয়ে অ্যাকাডেমি ছেড়ে অন্য মঞ্চ খুঁজে নিতে হয়েছে। সরকারের প্রায় প্রতিটি অপকর্মেই সোচ্চার হয়েছেন। সাধ্যমতো প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছেন।
কিন্তু তারপরেও আক্রমণ থেমে নেই। কিছু হলেই তাঁদের কাঠগড়ায় তোলা হয়। ‘চটি চাটা’, ‘তৃণমূলের দালাল’ এইসব আখ্যানে ভূষিত করা হয়। কোনও প্রতিবাদ মঞ্চে গেলে প্রশ্ন তোলা হয়, এতদিন পর মনে পড়ল! তারপর যা যা বিশেষণ ভেসে আসার, তাই আসে।
হ্যাঁ, এটা ঘটনা, তাঁরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে যতখানি সোচ্চার, বিজেপির বিরুদ্ধেও ততখানিই সোচ্চার। ক্ষমতার হাতবদল হলেও তাঁরা কোনওদিনই ওই গেরুয়া শিবিরে যাবেন না। বরং, তাঁদের প্রতিবাদ আরও তীব্রতর হবে। এতে বিজেপির রাগ থাকতে পারে। তাঁরা কুৎসা করতেই পারেন। কিন্তু বুঝে হোক, না বুঝে হোক, বামেরাও তাতে সামিল হয়ে যান। ফেসবুকে দুটো বাঁকা বাঁকা মন্তব্য করে তাঁরা ভেবে নেন, তাঁরা বুঝি বিরাট এক বিপ্লব দেখিয়ে ফেললেন।
দিনদিন এই সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর সত্যিই আস্থা হারিয়ে ফেলছি। হ্যাঁ, এই মিডিয়ার শক্তি অপরিসীম। এই মিডিয়ায় অনেক মানুষ গর্জে ওঠেন। মূলস্রোত মিডিয়ায় আড়ালে থাকা অনেক বিষয় উঠে আসে। কিন্তু পাশাপাশি এর অসহিষ্ণুতার দিকটাও মারাত্মক। অনেক সময় যেন ইতরতার উদযাপন চলে। বুঝে হোক, না বুঝে হোক, আক্রমণ করা যেন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকী সেই তালিকায় যখন বাম বন্ধুদেরও দেখি, তখন একটু বেশিই খারাপ লাগে। তাঁদেরও অসহিষ্ণুতার মাত্রা যেন বেড়েই চলেছে।
তাই এত এত লোক থাকতে বেছে নেওয়া হয় অপর্ণা সেন আর কৌশিক সেনকে। অপর্ণা সেন যদি একটু শাসক ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন, যখন তখন রাজ্যসভায় যেতে পারতেন। গত তেরো বছরে অন্তত কুড়িখানা ছবি বানাতে পারতেন। উত্তম কুমারের নায়িকা হিসেবে অনেক আগেই মহানায়ক সম্মান পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি এমনই এক অবস্থান নিয়েছেন যে, শাসক পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম ভাবারও সাহস দেখায়নি। যে কৌশিক সেন গত বারো–তেরো বছরে তাঁর মতো করে লড়ে চলেছেন। যে কৌশিক সেন শাসকের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেননি। যে কৌশিক সেন শাসকের দাক্ষিণ্যের পরোয়া করেননি। যে কৌশিক সেন পেশাগত এত ক্ষতিস্বীকার করেও তাঁর মতো করে প্রতিবাদ করে চলেছেন। সেই প্রতিবাদ সম্মান জানানো তো দূরে থাক, প্রতিনিয়ত ট্রোলিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। কিছু লোক আছেন, গালাগাল দেওয়াটাই যাঁদের কাজ। কিন্তু বাকিরা না বুঝেই তাতে সামিল হয়ে যাচ্ছেন। তখন সেই গালাগালটাই মূলস্রোত হয়ে পড়ছে।
এই লোকেরা কি দলের সম্পদ হতে পারে! এই লোকেরা কি শাসকের হাতকেই আরও শক্তিশালী করছেন না? এটাও ভেবে দেখার সময় এসেছে।