বিকিয়ে যাওয়ার মাঝে নিঃশব্দ প্রতিবাদের অজানা মুখ

স্বরূপ গোস্বামী

তাঁর নাম কাগজে ছাপা হবে না। গুগল সার্চে হাজার খুঁজলেও তাঁর নাম বা ছবি পাবেন না। আলিমুদ্দিনের বাম নেতারাও তাঁর নাম জানেন কিনা সন্দেহ। জানলেও কোনওদিন কোনও সাংবাদিক সম্মেলনে বলতে শুনিনি। তাঁর এই নিঃশব্দ লড়াই ইতিহাসের পাতা তো দূরের কথা, খবরের কাগজের পাতাতেও ছাপা হবে না। কোনও টিভি চ্যানেলে তাঁকে নিয়ে কোনও আলোচনার আসরও বসবে না।
অথচ, এই কঠিন সময়ে তিনিই হয়ে উঠতে পারতেন প্রতিবাদের মুখ।
নাম নিবৃত্তি মুখার্জি। বয়স ষাটের উপর। পরিচয়ঃ মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সদস্য ছিলেন। হ্যাঁ, ছিলেনই বলতে হবে। কারণ, এই মুহূর্তে তিনি সদস্য নেই। সারা রাজ্যে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ জেলায় যখন দলবদলের নামে কার্যত ‘প্রশাসনিক ডাকাতি’ চলছে, তার মাঝে তিনি এক ব্যতিক্রমী মুখ, তিনি এক প্রতিবাদী মুখ। যে প্রতিবাদ হয়ত সারা রাজ্যে মডেল হয়ে উঠতে পারত।

left

তিন বছর আগে মুর্শিদাবাদের ভরতপুর এলাকা থেকে জেলা পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন এই বর্ষীয়াণ মহিলা। আর এস পি কর্মী হিসেবে এলাকায় পরিচিতি ছিল। গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। তাই কঠিন সময়েও জিতে এসেছিলেন।
তারপর যা হয়! ক্রমাগত চাপ আসতে থাকে, শাসদ দলে যোগ দিতে হবে। গত কয়েক মাসে এই চাপ আরও বাড়তে থাকে। কেউ দিচ্ছেন প্রলোভন। কেউ দিচ্ছেন হুমকি। প্রলোভন হলঃ এদিকে চলে আসুন, কুড়ি লাখ টাকা পাবেন। আপনার এলাকায় কে ঠিকাদারি পাবে, আপনিই ঠিক করবেন। এমন নানা লোভনীয় প্রস্তাব।
আর হুমকি ? সেটা না হয় নাইবা লিখলাম। একজন মহিলাকে যে ধরনের হুমকি দেওয়া হয়ে থাকে, অনুমান করে নিন। সেই হুমকি থেকে ষাট বছরের মহিলারও নিস্তার নেই।
কী করবেন নিবৃত্তি দেবী ? পুলিশকে জানিয়ে যে ফল হবে না, এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি তাঁর আছে। পুলিশের মদতেই এই দল ভাঙানোর খেলা চলছে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন। দলীয় নেতৃত্বের পক্ষেও নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কী করণীয় ?
সেই টোপ গিলে ফেলা ? নাকি রুখে দাঁড়ানো ?
নানা লোকের নানা পরামর্শ। কেউ বলছেন, ‘ঝামেলা করে কী লাভ ? সবাই যাচ্ছে, আপনিও চলেই যান।’ নিজের সঙ্গেই যেন নিজের যুদ্ধ। ঠিক করলেন, একা একা লড়াই করতে যদি নাও পারি, অন্তত আত্মসমর্পন করব না। বিক্রি হয়ে যাওয়া লোকের ভিড়ে থাকব না। তার থেকে মাথা উঁচু করে বাঁচাই ভাল। শেষমেষ পদত্যাগের রাস্তাই বেছে নিলেন। হ্যাঁ, নিঃশব্দেই পদত্যাগ করলেন। এতে শাসকদলের উৎপাৎটা অন্তত কমল। অন্তত অপহৃত হওয়ার আশঙ্কা আর রইল না।
একদিকে যখন ‘উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ’, তখন এ এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ। কে এই প্রতিবাদের খোঁজ রাখে ! কাগজ, টিভি তো দূরের কথা। বাম নেতারাও খোঁজ রাখেননি।
ফেসবুক বা সোশাল সাইটে সকাল থেকে এত বিপ্লব। কিন্তু নিবৃত্তি দেবীর ছবি কেউ কখনও পোস্ট করেছেন বলে মনে হয় না। তাঁর এই নিঃশব্দ প্রতিবাদ নিজের দলে বা বাম সমাজে কোনও আলোড়ন তুলেছে বলেও মনে হয় না।
আসলে, আমরা তো প্রতিবাদ করতেই ভুলে গেছি। তাই যাঁরা ছিনতাই করছেন বা যাঁরা ছিনতাই হচ্ছেন, তাঁদের নিয়েই মেতে থাকি। যাঁরা প্রলোভনকে ফিরিয়ে দিতে পারেন, যাঁরা এখনও মূল্যবোধ আঁকড়ে থেকে নিঃশব্দে সরে যেতে পারেন, তাঁদের আমরা মনে রাখি না। তাঁরা আড়ালেই থেকে যাবেন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.