যত দিন যাবে, বিজেপির জনপ্রিয়তার গ্রাফটা ততই নেমে আসবে। তিন রাজ্যের এই পরাজয় অন্যান্য রাজ্যেও বিরোধীদের পালে হাওয়া তুলবে। সব ব্যর্থতাকে আড়াল করতে তখন হয়ত সার্জিকাল স্ট্রাইক বা যুদ্ধকেই ঢাল বানাতে হবে। আলোচনার সুরকে ঘুরিয়ে দেওয়ার এছাড়া কোনও রাস্তা নেই। লিখেছেন ধীমান সাহা।
মনে পড়ে যাচ্ছে প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। সেবার অনাস্থায় অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকার পড়ে গেছে। বিকল্প কোনও সরকার তৈরি করা যায়নি। নির্বাচন অনিবার্য। যতদিন না নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়, ততদিন পর্যন্ত বাজপেয়ীকেই কাজ চালিয়ে যেতে বললেন রাষ্ট্রপতি। আবার ভোট হলে কী হবে? তের মাসের সরকারে এমন কোনও উল্লেখযোগ্য ছাপ রেখে যেতে পারেননি যার ভিত্তিতে নিশ্চিত করে আবার ক্ষমতায় আসতে পারে। ঠিক তখনই, কারগিলে অনুপ্রবেশ। ব্যাস, জবরদস্ত একটা ইস্যু পাওয়া গেল। তামাম মিডিয়া প্রচার শুরু করে দিল, ভারত দারুণ জবাব দিয়েছে পাকিস্তানকে। গোটা নির্বাচন পর্বে অন্য কোনও প্রসঙ্গ সেভাবে উঠেই এল না। বিজেপি শুধু কার্গিলকে হাতিয়ার করেই নির্বাচনে গেল। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও আবার ফিরে এল বাজপেয়ীর সরকার। চলল পাঁচ বছর।
এবার তিন রাজ্যের ফলাফল দেখে কেন জানি না সেই কুড়ি বছর আগের কথাই মনে পড়ছে। এই তিন রাজ্যের ফল শুধু এই তিন রাজ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বিভিন্ন জায়গায় গ্রাফটা নামতে শুরু করেছে। এমনকী ঠিকঠাক জোট হলে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি তিরিশের নিচেও নেমে যেতে পারে। উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ — যেখানে যেখানে প্রায় একচেটিয়া জয় পেয়েছিল, সব জায়গায় আসন কমবে। এবং বেশ ভাল পরিমাণেই কমবে। বাড়ার জায়গা বিশেষ নেই। সবমিলিয়ে যা পরিস্থিতি, তাতে বিরোধীরা মোটামুটি ঐক্য করতে পারলে বিজেপির ২০০–র নিচে নেমে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত।
এমনিতেই নিজেদের কাজ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তেমন প্রচার থাকে না। অবান্তর কিছু ঢাক পেটানো। আর বাকিটা কদর্য ভাষায় রাহুলকে আক্রমণ করা। সরকারি সভা আর দলীয় সভার কোনও তফাতই থাকে না। এমন নির্লজ্জ আক্রমণ যে প্রধানমন্ত্রীকে মানায় না, সেই ন্যূনতম বোধটুকুও থাকে না। এখনই বলে দেওয়া যায়, নিজেদের শুধরে নেওয়ার বদলে এই আক্রমণের প্রবণতা আরও বাড়বে। কিন্তু এতেও ফল হবে না। দরকার আরও একটা মোক্ষম ইস্যু। পশ্চিমবঙ্গে হযত সারদা তদন্ত আবার জেগে উঠবে। কোথাও কোথাও সিবিআই–কে সক্রিয় করে তোলা হবে। কিন্তু তাতেও নিজেদের জয় নিশ্চিত নয়। দরকার আরও একটা মোক্ষম ইস্যু। কী হতে পারে? নিশ্চিত থাকুন, হাত থেকে হয় যুদ্ধ নয় আরেকটা সার্জিকাল স্ট্রাইক গোছের কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে হবে। কোনও এক তৃতীয় শ্রেণির জঙ্গিকে মেরে বিরাট উৎসব ও বীরত্বের প্রচার চলবে। এমনিতেই নানা জঙ্গি কার্যকলাপ চলবে। সেটাকে হাতিয়ার করে যুদ্ধের হুঙ্কার। আবার সেই দেশপ্রেমের বন্যা। পাকিস্তানকে শিক্ষা দিতে হবে। এই জাতীয় হুঙ্কার ছড়িয়ে পড়বে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর মূলস্রোত ন্যাশনাল মিডিয়া তো সঙ্গেই আছে। ইন্ধন দেওয়ার কাজে তাদেরও নির্লজ্জভাবেই লাগানো হবে। যে একটু ভিন্ন সুরে কথা বলবে, তার গায়ে দেশদ্রোহীর তকমা এঁটে দেওয়া হবে। আপনার কাছের মানুষেরাও দেখবেন হঠাৎ করে অন্য সুরে কথা বলছে।
হ্যাঁ, শাসকের বাঁচতে একটা যুদ্ধই দরকার। জওয়ানের লাশই তাঁদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। সেইসব জওয়ানের বাড়ির লোকেরাও হয়ত বলে বসবেন, উপযুক্ত বদলা নেওয়া হোক। পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়া হোক। সেইসব ফুটেজ ছড়িয়ে দেওয়া হবে সর্বত্র। আর আপনি–আমিও মেতে যাব সেই হুজুগে। একবারও ভেবে দেখব না এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় কার লাভ।যুদ্ধের সেই আশঙ্কাটা এখন থেকেই নথিবদ্ধ করে রাখলাম। পরে মিলিয়ে নেবেন।