অজানা বাড়ি দারিংবাড়ি

বৃষ্টি চৌধুরি
আমরা কতগুলো অদ্ভুত ধারনা নিয়ে বসে থাকি। আমাদের কাছে রাজস্থান মানেই মরুভূমি, আমাদের কাছে বৃষ্টি মানেই চেরাপুঞ্জি। আরও কত কী ধারনা করে বসে আছি। সেই ধারনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না। কী জানি, হয়ত বেরিয়ে আসতে চাইও না।
ওড়িশা মানে আমরা কী বুঝি ? ভ্রমণ রসিক গড়পড়তা বাঙালির কাছে ওড়িশা মানে পুরী। আর পুরী মানেই সমুদ্র। বড়জোর আশেপাশের দু একটা মন্দির, চিড়িয়াখানা। আমিও এরকম একটা ভ্রান্ত ধারনার শিকার ছিলাম। এখন বুঝি, ওড়িশা মানে আরও অনেককিছু। পাশে থাকা এই রাজ্যটাকে আমরা চেনার চেষ্টাই করলাম না। এই কারণেই বোধ হয় রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া / ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া / একটি ধানের শিসের উপরে / একটি শিশিরবিন্দু।

ভাবসম্প্রসারণে লিখতাম, শিশিরবিন্দু কথাটাকে আক্ষরিক ধরলে মস্তবড় ফাঁক থেকে যাবে। আশেপাশে এমন অনেককিছুই রয়ে গেছে উপেক্ষিত শিশিরবিন্দু হয়ে। তেমনই একটা জায়গা হল দারিংবাড়ি। ওড়িশার মধ্যে একখণ্ড কাশ্মীর আছে, তা আমরা কজন জানি! অকপটে স্বীকার করছি, আমি অন্তত জানতাম না। এই না জানাটা ছিল গ্র্যাজুয়েশনের আগে পর্যন্ত। এক মামা থাকতেন ওড়িশায়। তিনি বলতেন দারিংবাড়ির কথা। সেখানে নাকি পাহাড় আছে। আর এই দারিংবাড়িকে নাকি বলা হয় ওড়িশার কাশ্মীর।
শুরুতে মনে হয়েছিল বাড়াবাড়ি। কথায় কথায় একটা তুলনা জুড়ে দেওয়া আমাদের স্বভাব। ইন্টারনেট ঘেঁটে কিচু ছবি দেখলাম। বেশ ভালই লাগল। বাড়িতে অনেকে বলছিল, দার্জিলিং যাওয়ার কথা। আমি বললাম, দার্জিলিং তো আগেও গেছি, আবার যাব। তার বদলে কাছাকাছি কাশ্মীরে গেলে কেমন হয়? কাশ্মীর ? তাও আবার কাছাকাছি ? নির্ঘাত আমাকে অনেকেই পাগল ভাবছিল। সেটাই স্বাভাবিক। আমি বললাম, ‘অত দূরে নয়, কাছেই ওড়িশার ভেতর একটা কাশ্মীর আছে।’ এবার তো নিশ্চয় সবাই বদ্ধ পাগল ভাবছিল।
না, ফিরে আসার পর কেউ আমাকে গালমন্দ করেনি। বরং নতুন একটা জায়গায় সবাইকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলাম বলে তারা বেশ খুশিই হয়েছিল। কাছাকাছি স্টেশন বলতে বেরহামপুর। সেখান থেকে গাড়িতে ঘণ্টা তিনেকের পথ। ভাড়া মোটামুটি হাজার দুইয়ের মতো। পুরো পথটা যে পাহাড়ি, তা নয়। বেশিরভাটাই সমতল। কিন্তু যেখান থেকে পাহাড়ে উঠছে, সেখান থেকেই যেন অন্য এক রোমাঞ্চ। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে কত রহস্য। দার্জিলিংয়ে যাওয়ার পথে দেখেছি চায়ের বাগান। এখানে চোখে পড়বে কফির বাগান। কখনও পেরিয়ে যাচ্ছি ঘন পাইন বন, কখনও সবুজ উপত্যকা।
আবার কখনও ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ। এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে। পৌঁছে গেলাম দারিংবাড়ি। থাকার বুকিং আগে থেকেই করা ছিল। ওটিডিসি-র বাংলোটা বেশ ভাল। তবে খরচ একটু বেশি। আগে থেকে বুকিং পেলে এখানে থাকাই ভাল। শুনেছি, ফরেস্টের একটা বাংলো আছে। সেটাও নাকি সুন্দর। আছে ইকো হোম।


আশেপাশে যাওয়ার জায়গা অনেক আছে। একদিন একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হল। পাবেন দুলুরি নদী, পুতুদি জলপ্রপাত। দেখতে পাবেন গোলমরিচ বাগান। আর দিগন্তজুড়ে কফি বাগান তো আছেই। যদি কোথাও যেতে না চান, তাও চলবে। আশপাশের এলাকাটা হেঁটে বেড়ান। নিস্তব্ধতা পাবেন। পাখির ডাক পাবেন। গ্রাম্য সুন্দর একটা পরিবেশ পাবেন। ভেসে যাওয়া মেগ পাবেন। মিটে রোদ ? তাও পাবেন। সবমিলিয়ে কমপ্লিট প্যাকেজ বলতে যা বোঝায়, তাই পাবেন।
শোনা যায়, শীতে নাকি এখানে বরফ পড়ে। আমার অবশ্য শীতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে যখনই যান, শীতবস্ত্র নিয়ে যাবেন। শোনা যায়, রেন ফরেস্ট, জন্তু জানোয়ার থাকতে পারে। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একসময় মাওবাদী আতঙ্ক ছিল। এখনও পুরোপুরি সেই আতঙ্ক গেছে, এমনটা নয়। তবে ভরসা করে যেতেই পারেন।
পুজোয় কোথায় যাবেন, এখনও ঠিক করেননি ? তাহলে ঘুরেই আসুন দারিংবাড়ি। বিশ্বাস করুন, ভাল লাগবে। হাতের কাছে এমন এক কাশ্মীর থাকতে একবার উকি মেরে আসবেন না !

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.