ভ্রমণ
স্বরূপ গোস্বামী
৩১ জুলাই, রাত ১১ টা
সে ভারী অদ্ভুত লোক। যা জিজ্ঞেস করি, সবেতেই ‘হাঁ সাব’। এমনকি পরস্পরবিরোধী দুই প্রশ্ন হলেও দুবারই শুনতে হবে, ‘হাঁ সাব’। হিসেবের কথা উঠলে, একটা কথাই যেন মুখস্থ- ওয়ান ফিফটি।
নিশ্চয় ভাবছিস, লোকটা কে? এই গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার। নাম লকপত। গেস্ট হাউস থেকে অনেক নিচে একটা গ্রামে ওর বাড়ি। গ্রামের নামটা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম। কী যে বলছে, বোঝাই মুশকিল। ওর অদ্ভুত উচ্চারণে একেকবার একেক রকম শোনালো। আর বোঝার চেষ্টা না করে, এটুকুই বুঝলাম, গেস্ট হাউসের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা নিচে নেমে গেছে, সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর নেমে গেলে ওর গ্রাম। এটুকু জানাই ভাল। মনে পড়ে গেল ‘হীরক রাজার দেশে’র সেই সংলাপটা- জানার কোনও শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই। এত জেনে কাজ নেই বাপু। থাকব তো দুদিন। তবে সামনের দুদিন এই লকপতই আমাদের ফ্রেন্ড ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড।
শুরুই করলাম লকপতকে দিয়ে। লকপত যে গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার, এটাও বলে ফেলেছি। কিন্তু হঠাৎ গেস্ট হাউস কেন, কোথায়ই বা এলাম, এ নিয়ে কৌতূহল হতেই পারে। আগে থেকে বলে রাখলে হয়ত কৌতূহল হত না। তখন পৌঁছনো সংবাদটুকু জানিয়ে দিলেই হত। বা ইদানীং তো লোকে যা যা করে, ফেসবুক আপডেট দিয়ে দেয়। আমি এখন চা খাচ্ছি, আমি এখন অফিসে ঢুকলাম। ঢুকলি বেশ করলি। দুনিয়ার লোককে ঢাক পিটিয়ে জানানোর কী আছে বাপু? শুধু কি তাই, পেট খারাপ হলেও দেশ দুনিয়াকে ঢাক পিটিয়ে জানায়। কী আশ্চর্য! তাতে অসংখ্য বোকা বোকা কমেন্ট আর লাইকও পড়ে যায়। তারা যে বাইরে বেড়াতে এলে কী করত, কে জানে! প্রতিটি বাঁকে এসে ছবি তুলত। আর দেশশুদ্ধু লোককে জানিয়ে দিত। ভাগ্যিস, আমরা যে চারজন এসেছি, তাদের মধ্যে কেউ ফেসবুক আসক্ত নই। বাকি তিনজনের অ্যাকাউন্ট থাকলেও তাদের মধ্যে যে খুব একটা আসক্তি নেই, তা এই একদিনেই বেশ বুঝেছি। অন্তত এই একদিনে অস্বাভাবিক কোনও ছোঁকছোঁকানি দেখিনি। আর এই অধমের নামে তো কোনও অ্যাকাউন্টই নেই। একটা অ্যাকাউন্টে মাঝে মাঝে ঢুকি, সেও আমার নিজস্ব নয়। তার পাসওয়ার্ড অন্তত জনা দশেক লোক জানে। থাক ওসব কথা। এই মেঘের দেশে এসে ওসব কথা টেনে না আনাই ভাল।
আবার এসেছি পাহাড়ে। এই পাহাড়ে তোর সঙ্গে কোনও স্মৃতি নেই। তবু কেন জানি না, পাহাড় এলেই তোর কথা বড় বেশি করে মনে পড়ে যায়। একটার পর একটা মেঘ উড়ে আসে। মন কেমন যেন উদাস হয়ে পড়ে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির নানা গান আপনাআপনিই গলায় এসে যায়। জগজিৎ সিং থেকে মান্না দে, হেমন্ত থেকে শ্রীকান্ত- সবাই এসে পড়ে। আর আমাদের অস্তিত্ব ও অভ্যাসের অঙ্গ রবি ঠাকুর তো আছেনই। কবিতায় কখনও শক্তি চাটুজ্জে তো কখনও জয় গোঁসাই। সেই গান বা কবিতায় প্রেম আছে, বিরহ আছে, নিসঙ্গতা আছে। লুকোনো অভিমান! তাও বেশ আছে।
আমি না একটা যাচ্ছেতাই। একদিকে বৃষ্টি, কবিতা, গানের কথা বলছি। আর বেরসিকের মতো একথা থেকে সে কথায় হারিয়ে যাচ্ছি। কোথায় এসেছি, সেটাই তো এখনও বলিনি। জায়গাটার নাম বাগোড়া। নিশ্চয় শুনিসনি। না, এর জন্য তোর হীনমণ্যতায় ভোগার কিছু নেই। শতকার নিরানব্বই ভাগ বাঙালিই জানে না। এমনকি যারা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়, তারাও জানে কিনা সন্দেহ। এটা কার্শিয়াং ফরেস্ট রেঞ্জের মধ্যেই পড়ছে। কার্শিয়াং পর্যন্ত কীভাবে আসতে হয়, নিশ্চয় বলতে হবে না। দুটো রাস্তা, একটু জেনে রাখ (যদি কখনও আসিস)। কার্শিয়াং থেকে যে রাস্তাটা দার্জিলিংয়ের দিকে যাচ্ছে, সেই রাস্তা ধরে আরও মিনিট কুড়ি যেতে পারিস। টুং পেরিয়ে দিলারাম বলে একটা জায়গা পড়বে। সেখান থেকে ডানদিকে একটা রাস্তা উঠে গেছে। এয়ারফোর্স স্টেশনের দিকে। বেশ খাড়া পথ। প্রায় চার কিমি। খাড়া পথে চার কিমি মানে অনেকটা। এটাই বাগোড়া পৌঁছনোর সহজতম রাস্তা। নইলে কার্শিয়াং থেকে ডাউহিল দিকে যাওয়ার যে রাস্তা, সেই রাস্তা ধরে চিমনি পেরিয়ে বাগোড়া পেয়ে যাবি।
চারিদিকে পাইন গাছের ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলের ভেতর সূর্যের আলোও ঢোকে না। দিনের বেলাতেও একটা অন্ধকার অন্ধকার ভাব। সেই সঙ্গে মেঘের ভেসে বেড়ানো তো আছেই। সব মিলিয়ে জায়গাটায় এলে মন ভরে যাবে। হয়ত ভাবছিস, থাকব কোথায়? চুপি চুপি জানিয়ে রাখি, আমরা আছি ফরেস্টের গেস্ট হাউসে। বুকিংয়ের একটু ঝামেলা আছে। অনেক আগে থেকে কার্শিয়াং ডি এফ ও-কে জানিয়ে রাখতে হবে। তিনি কনফার্ম করলে তবেই বুকিং। ফাঁকা থাকলেই যে পাওয়া যাবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। মাত্র দুটি ঘর। বুঝতেই পারছিস। কখন কোন ভিআইপি এসে পড়বেন, সেই ভেবে খালি রাখতে হয়। এগুলোয় পর্যটকরা থাকুক, বন দপ্তর এমনটা চায় বলে মনে হয় না। আমরা পেয়েছি আমাদের সঙ্গের এক আধিকারিক বন্ধুর জন্য। সে ব্যাটা কয়েকদিন ধরে মেল পাঠিয়ে, ফোন করে, ডিএফও-র পেছনে মার্কারের মতো লেগেছিল। তাই হয়ত না দিয়ে পারেনি। তবে এই বাংলোর ভরসায় এলে একটু মুশকিলই আছে। তাই এসেই একটা হোম স্টে-র সন্ধান করে নিয়েছি। ডিকি হাউস। বাগোড়া বাজার থেকে একটু এগোলেই এই হোম স্টে। জনা পনেরো থাকতেই পারে। একটু আগে থেকে ফোন করে এলে সমস্যা নেই। আজ আপাতত এটুকুই থাক। বাকিরা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সময় পেলে কাল আবার লিখব।
১ আগস্ট, সকাল দশটা
কাল হঠাৎ করে থেমে গিয়েছিলাম। বুঝতেই পারছিস, বাইরে এলে তো অখণ্ড অবসর থাকে না। দল বেঁধে এলে তো আরও থাকে না। অন্যদের কথা মাথায় রাখতে হয়। সেই অনুযায়ী টাইম অ্যাডজাস্ট করতে হয়। যেমন, আজ উঠেছিলাম বেশ ভোরেই। এক রাউন্ড হাঁটা হয়ে গেল। সে কথায় পরে আসছি। কেন এই বাগোড়ায় এলাম, এই সুযোগে বরং সেটা একটু বলে নেওয়া যাক। কোথায় যাওয়া যায়, এই নিয়ে নানা আলোচনা চলছিল। যেহেতু আমি কর্মসূত্রে প্রায় বছর দেড়েক উত্তরবঙ্গে ছিলাম, তাই অনেকে ভাবে আমি বোধ হয় উত্তরবঙ্গ বিশারদ। আমি বোধ হয় পাহাড়ের অলিগলি চিনি। চিনি না বললেও কেউ বিশ্বাস করে না। কেউ ভাবে বিনয় দেখাচ্ছি, কেউ ভাবে দায়িত্ব এড়াতে চাইছি। তাই আমাকেও চিনি এরকম একটা ভাব করতে হয়। তবে এই বাগোড়া অবশ্য একেবারে অজানা ছিল না। ঠিক এক বছর আগে একবার চিমনিতে দুদিন ছিলাম। সেদিনই এক ফাঁকে ঘুরে গিয়েছিলাম এই বাগোড়া থেকে। সেবার থাকা হয়নি। কিন্তু ইচ্ছে ছিল, একদিন না একদিন এই বাগোড়ায় ফিরে আসব। তাই বাকিরা যখন আমার উপরেই ছেড়ে দিল, তখন মনে হল, এই সুযোগে ওদের একটু বাগোড়ায় ঘুরিয়ে আনা যাক। খারাপ লাগবে না, এটুকু নিশ্চিত ছিলাম। যে তিনজন সঙ্গে ছিল, তাদের কথা বরং বলা যাক। একজন সন্তু । সরকারি আধিকারিক। এর বেশি আপাতত বলছি না। দ্বিতীয় জন রূপম। পেশায় শিক্ষক, কিন্তু নেশা ক্যামেরা। এই দুজন পূর্ব পরিচিত। দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের সহপাঠা (পুং লিঙ্গ, তাই সহপাঠী বললাম না, সহপাঠা-টাই ভাল, কী বলিস!)। আরেকজন দেবাশিস। বাড়ি পান্ডুয়ার কাছে, রূপমের স্কুলেই অঙ্কের শিক্ষক। রূপম একাই বিবাহিত, বাকি আমরা তিনজনই জীবিত। তবে বিবাহিত বলে রূপমকে গৃহপালিত প্রাণী ভাবার কোনও কারণ নেই। ও বরং আমাদের থেকেও বেশি বাউন্ডুলে। সারা বছর সুযোগ পেলেই ক্যামেরা নিয়ে এখান ওখানে বেরিয়ে পড়ে।
তবে সব সময় ক্যামেরাধারীদের সঙ্গে গড়পড়তা টুরিস্টদের একটা তফাত থাকে। আমরা যখন মেঘ দেখে রোমান্টিক হয়ে উঠছি, ও তখন প্রকৃতিকে গালমন্দ করছে। ও চায় রোদ। নইলে ছবি ওঠে না। আজ সারাদিন রোদের দেখা নেই। শুধু বৃষ্টি। বাংলোর কাঁচের জানালার এপার থেকে বৃষ্টি দেখতে বেশ ভালই লাগছিল। জেনেশুনেই তো বর্ষাকালে এসেছি। বৃষ্টি হবে, এই মানসিক প্রস্তুতি তো ছিলই। তাছাড়া,আমাদের তো তথাকথিত ‘সাইট সিন’ দেখার কোনও পরিকল্পনাও ছিল না। জঙ্গল আর পাহাড় ঘেরা এইবাগোড়ায় অলসভাবে দুটো দিন কাটবে, এর থেকে বেশি চাওয়া তো কিছু ছিল না। তাই কখনও বৃষ্টি পড়বে, কখনও থামবে। এতে আশ্চর্যের কী আছে? বিরক্তিরই বা কী আছে ? কী জানি, রূপম হয়ত মনে মনে খুব রেগে আছে। ব্যাটা ক্যামেরা বের করে বসে আছে। সামনে এমন ঝাপসা, কোনও ছবিই আসবে না। ছবি সম্পর্কে ওর একটা প্যাশন আছে। ওর ছবির রীতিমতো এগজিবিশন হয়। ফিল্ম ফেস্টিভালেও অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার। মাঝে মাঝেই ছবি তোলার নানা গল্প উঠে আসছে। শুনতে বেশ ভালই লাগছে। ছবি তোলার গল্প যত না বলছে, স্কুলের কথা বা ছাত্রদের কথা সে তুলনায় অনেকটাই কম। বোঝা গেল, মাস্টারিটা ওর চাকরি। কিন্তু প্রথম প্রেম ওই ছবিটাই। থ্রি ইডিয়টস দেখেছিস ? সেই ফারহানের কথা মনে পড়ে গেল। সে ইঞ্জিনায়ারিং ছেড়ে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার হয়েছিল। ইসস, রূপমও যদি এমন হতে পারত!
১ আগস্ট, সন্ধে ৭ টা
ভোরে ঠিক মতো ঘোরা হয়নি। ব্রেকফাস্ট সেরে বেলার দিকে আবার বেরিয়েছিলাম। কিছুটা হেঁটে গেলে এয়ারফোর্স স্টেশন। ঘুরতে ঘুরতেকাছে পৌঁছে গেলাম। এই তল্লাটে এটাই সবথেকে উঁচু জায়গা। এখান থেকে পরিষ্কার সবকিছু দেখা যাচ্ছে। মনে হল, একবার এয়ারফোর্স স্টেশনে ঢুকলে কেমন হয়? ঢুকতে যে দেবে না, সেটা মোটামুটি জানাই ছিল। তবু নিরীহ পর্যটক ভেবে যদি ছাড় দেয়! গেটে গিয়ে সিকিউরিটিকে বললাম। সে দেখিয়ে দিল তার বসকে। ভেতরে দিয়ে সিকিউরিটি অফিসারকে বললাম। ওই যেভাবে বলে আর কী! বোঝা গেল, তিনিও অ্যালাউ করতে পারবেন না। কিন্তু তিনি আর তাঁর ওপরওয়ালার কাছে পাঠালেন না। খুব সুন্দরভাবে আমাদের ভাগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ভেতরে ঢুকে কী দেখবেন? এই ছোট্ট একটা এয়ারফোর্স স্টেশন। দেখার কিছুই নেই। ভেতরে ন্যাচারাল বিউটি বলে কিছুই নেই। আমরা বোর হয়ে গেলে বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি। আর আপনারা কিনা বাইরে থেকে ভেতরে এলেন! বাইরেটা ভাল করে ঘুরে দেখুন। জঙ্গলে হেঁটে আসুন, ভাল লাগবে। ’ অগত্যা, আবার বেরিয়ে পড়া।একটা অন্ধকার রাস্তা ধরে অনেকটা হেঁটে গেলাম। আরও যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তা বলে কথা। নামার সময় দিব্যি নামা যায়। ওঠার সময় দম বেরিয়ে যায়। তাই নামার সময় মনে রাখতে হয়, এই পথেই আবার উঠে আসতে হবে। কিছুদূর গিয়ে একটা পাথরের ওপর অনেকক্ষণ আড্ডা। এবার সন্তুর পালা। সরকারি কাজকর্ম থেকে পাড়ার রাজনীতি, নানা কথা উঠে এল। মোটামুটি সবাই বাম মনস্ক। তবু বামেদের কী করা উচিত, তা নিয়ে একপ্রস্থ ভালই তর্ক হয়ে গেল। কোন মিডিয়া কতখানি সমঝোতা করল, কোন বুদ্ধিজীবী কেন বেসুরো গাইছে, নানা মত উঠে এল। এই পাহাড়েও সিন্ডিকেট,সারদা বা এসব আলোচনা থেকে নিস্তার নেই।
কাল শুরু করেছিলাম লাকপতের কথা দিয়ে। তারপর তার কথা আর বলাই হয়নি। লোকটা বেশ সরল।সব সময় মুখে একটা হাসি লেগেই আছে।মাঝে মাঝেই জি সাব। আমরা সবাই ঠিক করলাম, সন্তুকে বড়সাহেব বলে দেখাব। লাকপতের সামনে আমরাও সন্তুকে স্যার স্যার বলে ডাকতে লাগলাম। সন্তুও গাম্ভীর্য বজায় রেখে বুঝিয়ে দিল, চেহারায় ছোটখাটোহলে কী হবে, সে সত্যিই হোমড়াচোমড়া। কিন্তু লাকপত এতসব থোড়াই বোঝে! তাকে যে কোনও খাবারের দাম জিজ্ঞেস করলে, সে কিছুক্ষণ পর বলবে ওয়ান ফিফটি। ভাত, ডাল, তরকারি, মাংস সবমিলিয়ে একটা মিলে কত পড়বে ? তার জবাব ওয়ান ফিফটি। শুধু এক জায়গায় মাংস নিয়ে চার জায়গায় ভাগ করে নিলে কত পড়বে ? উত্তর সেই একটাই, ওয়ান ফিফটি। টিফিন বা স্ন্যাক্ল ? শুনে হোক, না শুনে হোক, উত্তর সেই ওয়ান ফিফটি। ভাগ্যিস, আর চায়ের দাম জিজ্ঞেস করিনি। তবে রান্নার হাতটা বেশ ভাল। বিশেষ করে মাংসটা। এমনকি দুপুরে যখন ডিমের কারি করছে, সেটাও চমৎকার। ডাল তো আছেই। এমন কিছু সবজি,যা সমতলে জোটে না। সবমিলিয়ে পঞ্চব্যঞ্জন সহযোগে বেশ ভালই লাগছে।
২ আগস্ট, বেলা ১১ টা
এবার বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গেল। আজ বেশ ভোরেই বেরিয়েছিলাম। বাগোড়া থেকে চার পাঁচ রকম রাস্তাচলে গেছে। সবগুলোতেই একটু একটু করে ঘোরা হয়ে গেছে। একটা রাস্তাই বাকি ছিল। ভোরের দিকে মনে হল, সেদিকটায়একটু হেঁটে আসি। আমরা আছি সাত হাজার ফুটেরও উপরে। বোধ হয় এখানটা দার্জিলিং থেকে উঁচুই হবে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সোজা একটা রাস্তা চলে গেছে। কিছুদূর গিয়ে বুঝলাম, ওটা যাচ্ছে চটকপুরের দিকে। হাতে সময় থাকলে দিব্যি হেঁটে হেঁটেই চটকপুর চলে যাওয়া যেত। সন্তু অবশ্য আসেনি। ওকে দু তিনবার তোলা হল। মুখটা দেখে খুব মায়া হল। মনে হল, ছেলেটা ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যখন অনেকটা চলে গেছি, বেচারার জন্য বেশখারাপই লাগছিল। এত সুন্দর একটা দিক রয়েছে, বেচারা জানতেই পারল না! ঘন পাইন বন। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাটা ভেজা। একটু অন্ধকার অন্ধকার ভাব। এই অন্ধকার বলতে কাল একটা মজার কথা মনে পড়ল। বিকেলের দিকে রূপম ফোনে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল। সে কথায় কথায় বলেছে, ‘সকালে যেদিকে গিয়েছিলাম, রাস্তাটা পুরো অন্ধকার, সূর্যের আলোও ঢোকে না।’ বেশ রোমাঞ্চিত শোনাচ্ছিল মাস্টারমশাই কাম আলোকচিত্রীর গলা। কিন্তু কে জানত, অপর প্রান্ত থেকে এমন ধমক জুটবে! মাসিমা বলে দিলেন, ‘এত অন্ধকারে যাওয়ার কী দরকার?’ রূপমের উচ্ছ্বাস তখন কিছুটা যেন চুপসে গেল। মায়ের আর দোষ কী? মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় ভাবসম্প্রসারণ আসত- ‘স্নেহের স্বভাবই এমন, অকারণ অনিষ্টের আশঙ্কা করে।’ ভোরে হাঁটতে গিয়েও বিভ্রাট। রূপম ছবি তুলছে। পোজ দিয়ে দাঁড়িয়েছে দেবাশিস। পায়ের কাছেই একটা সাপ। দেখতে পেয়েই ভয়ে লাফিয়ে পড়ল দেবাশিস। ব্যালান্স রাখতে না পেরে পা-টা গিয়ে পড়ল সাপের মাথায়। দেবাশিস বেঁচে গেল। কিন্তু সাপটা অকালেই পর্যটকের হাতে প্রাণ দিল। হয়ত তেমন বিষাক্ত ছিল না। তবু হাজার হোক, সাপ তো। তবে সাপ শুনে তোর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বর্ষার সময় দু একটা নিরীহ সাপ বেরোয়। পুজোর পর তারা দিব্যি শীতঘুমে চলে যায়। রাস্তাটায় কিন্তু একেবারেই চড়াই উতরাই নেই।দিব্যি হেঁটে যাওয়া যায়। ফিরেও আসা যায়। ফেরার সময় হয়ে এল। আবার নিশ্চয় আসব। এই পথে যদি ভোরের বেলা তোর সঙ্গে হেঁটে যাই! কোন গানটা গাওয়া যায়? রবি ঠাকুর, ক্ষমা করবেন। এমন সময়ে সপ্তপদীর সেই গানটাই সবার আগে মনে পড়ে যাবে।