(চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে কত তারকার ভিড়। কত প্রশস্তির বন্যা। অথচ, এই মঞ্চে এখন জায়গা হয় না মিঠুন চক্রবর্তীর। বলিউডে সবচেয়ে সফল বাঙালি ব্রাত্য। পরপর পাঁচ বছর। অথচ, একসময় মঞ্চ আলো করেই থাকতেন এই বঙ্গ সন্তান। সেই মঞ্চ থেকে আজ অনেক দূরে। তিন বছর আগে (২০১৫) চলচ্চিত্র উৎসবের সময় বেঙ্গল টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল লেখাটি। এই চলচ্চিত্র উৎসবের আবহে আবার ফিরিয়ে আনা হল। )
স্বরূপ গোস্বামী
জানি না, আপনি এখন কোথায় ।
বাংলায় নেই, এটুকু জানি। কিন্তু দেশে নাকি দেশের বাইরে ? মুম্বইয়ে আপনার দেখা পাওয়া যায় না। সাজানো শহর উটিতেও নাকি পাওয়া যায় না। আপনার অনেকদিনের চেনা-জানা লোকেরাও নাকি আপনার হদিশ জানেন না।
যেখানেই থাকুন, আজকের দিনে নিশ্চয় মন পড়ে থাকবে কলকাতায়। নেতাজি ইনডোরে জমকালো অনুষ্ঠান। কে নেই ? অমিতাভ বচ্চন থেকে জয়া বচ্চন। মাধুরী দীক্ষিত থেকে বিদ্যা বালান। অনিল কাপুর থেকে গোবিন্দা। আর আমাদের বাংলার তারকারা তো আছেনই।এত তারকার ভিড়ে আপনি নেই ? সেই মঞ্চে মিঠুন চক্রবর্তীর জায়গা হল না ?
অথচ, বছর দুই আগেও তো ছবিটা এমন ছিল না। ২০১২ ও ২০১৩ পরপর দুবারই চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চ আলো করে ছিলেন আপনি। অমিতাভ, শাহরুখ, কমল হাসানরা ছিলেন। কিন্তু আমাদের ঘরের ছেলে হয়ে দীর্ঘদিন বলিউড শাসন করা আপনিও ছিলেন স্বমহিমায়। অমিতাভকে আমরা শহরের জামাই বলি ঠিক কথাই, শাহরুখ এই রাজ্যের ঘোষিত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর- এটাও ঘটনা। জামাই বা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর কি আর ঘরের ছেলের জায়গা নিতে পারে ? আমাদের মনের ভেতর কোথাও একটা আলাদা আসন ছিল আপনার জন্য।
গত বছর কত ঘটা করে আপনাকে রাজ্যসভার এম পি করা হল। কোন দলের হয়ে গেছেন, সেটা বড় কথা নয়। মনে হয়েছিল, এই সুযোগটা আপনার প্রাপ্য ছিল। তিন তিনটে জাতীয় পুরস্কার, লড়াই করে মুম্বইয়ের মাটিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার গৌরবজনক লড়াই, সর্বোচ্চ আয়কর দেওয়ার জন্য চার বার আয়কর দপ্তরের বিশেষ পুরস্কার। আর সারা বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সমাজসেবার নানা কাহিনী। এত যাঁর অবদান, তাঁকে তৃণমূল নেত্রী এই স্বীকৃতি দেওয়ায় খারাপ লাগেনি। বলা হয়েছিল, রাজ্যের ভাবমূর্তি তুলে ধরার কাজে আপনাকে ব্যবহার করা হবে। দেশের নানা প্রান্তে, এমনকি বিদেশে নিয়ে যাওয়া হবে আপনাকে। আপনি শিল্পপতিদের আহ্বান জানাবেন, বাংলায় আসুন, শিল্প করুন।
লোকসভা ভোটে পুরোদমে প্রচারেও নেমে পড়লেন। কোচবিহার থেকে পুরুলিয়া, আপনাকে দেখার জন্য উপচে পড়া ভিড়। ছড়িয়ে গেল স্লোগানটা —বোতাম টিপব এখানে, সরকার গড়ব ওখানে। কিন্তু তারপর থেকেই কোথায় যে হারিয়ে গেলেন! মাঝে মাঝে খবর হয়, ইডি-র সমন। কোনওদিন আপনি হাজিরা দিচ্ছেন, কোনওদিন আপনার আইনজীবী। মনে হচ্ছিল, ওই টাকা নিশ্চয় ফিরিয়ে দেবেন। হ্যাঁ, সেটাই করেছেন। ভেবেছিলেন, মানসিক সান্ত্বনা পাবেন। কিন্তু যাঁরা মিঠুনকে একটু হলেও চেনেন, তাঁরা জানেন, ভেতরে ভেতরে কতটা বিধ্বস্থ আপনি।
গতবছর ফিল্ম ফেস্টিভাল। সেবারও সারা দেশের তামাম তারকারা হাজির। সেই মঞ্চে অচ্ছুৎ রইলেন শুধু আপনি। আপনি কি নিজেই দূরে সরে থাকতে চেয়েছেন ? নাকি এত তারকাকে পেয়ে সরকার আপনাকে আমন্ত্রণ জানাতেই ভুলে গেছে ? জানি না। শুধু জানি, সেই মঞ্চে আপনি ছিলেন না।
এবারও তাই। গত কয়েকদিন ধরে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অমিতাভ আসছেন, রজনীকান্ত আসতে পারেন। জয়া, মাধুরী, মৌসুমী, বিদ্যা—কত নাম রোজ ভেসে উঠল। কেউ প্রশ্ন করল না মিঠুন নেই কেন ? বছর তিনেক আগে, যতদূর মনে পড়ছে, আপনি ছিলেন ইউরোপে। শুধু এই অনুষ্ঠানে হাজির থাকবেন বলে একটা দিনের জন্য উড়ে এসেছিলেন। এখন আপনি রাজ্যের সাংসদ। এখন রাজ্যের ডাকে ছুটে আসবেন না, বিশ্বাস হয় না। তাহলে কি কোথাও একটা উপেক্ষা ও অপমানের যন্ত্রণা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ?
এম পি হওয়ার আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এম পি হওয়াটা আমার কাছে বড় কিছু নয়। কিন্তু যদি কখনও দিদি-ভাইয়ের সম্পর্কে সামান্য আঁচড় পড়ে, তাহলে সেদিন ছেড়ে দিতে দু মিনিট সময় নেব না। দিদি-ভাই সম্পর্কের উষ্ণতা এখন কেমন, জানি না। কিন্তু ফিল্ম ফেস্টিভালের মঞ্চে আপনাকে না দেখে কেমন যেন খটকা লাগছে। আবার সেই এক প্রশ্ন। আপনাকে আদৌ ঠিকঠাক আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তো ?
মধ্যপ্রদেশ কিঞ্চিৎ স্ফীত হয়েছে। ‘কমতে থাকা চুলের ফাকে মাঝবয়সের সংস্কৃতি’ কিছুটা প্রকট হয়েছে। কিন্তু কী করে ভুলে যাব, আমাদের কিশোর মনে ঝড় তোলা সেই মানুষটাকে ? পরের দিকে আপনার অনেক ছবি দেখে হয়ত ‘বিজ্ঞসুলভ’ নাক সিঁটকেছি। কিন্তু সেই ফেলে আসা দিনগুলোর নস্টালজিয়াকে তো অস্বীকার করতে পারি না। অমিতাভ না মিঠুন- এই তর্কে টিউশনি, স্কুল, পাড়ার রক থেকে খেলার মাঠে কত তর্ক হয়েছে। সেই মেরুকরণ সিপিএম বনাম তৃণমূল মেরুকরণের থেকেও প্রকট ছিল। সেই মিঠুন এই জাঁকজমক থেকে হাজার মাইল দূরে, মানতে কষ্টই হচ্ছে।
অনেকে সারদা কান্ডে বাকিদের সঙ্গে আপনাকেও কী অবলীলায় গুলিয়ে ফেলে। সেই যুক্তিতে আজও সায় দিতে পারি না। মন বলছিল, আপনি টাকা ফিরিয়ে দেবেন। সেটাই হয়েছে। এখনও মন বলছে, আরও কোনও কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য হয়ত মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছেন। আপনার পদত্যাগ চাইব না। কারণ, কখন কী পদক্ষেপ নিতে হবে, আপনি সবার থেকে ভাল জানেন।
যখন এম পি হিসেবে শপথ নিচ্ছেন, তখনই মনে হয়েছিল, এই পরিচয়টা হয়ত সারাজীবনের কলঙ্ক হয়ে দাঁড়াতে পারে। একবুক দ্বিধা ছিল। আজ আপনি নিজেও বুঝছেন, এই কাঁটার মুকুট পরার যন্ত্রণা। এই বাংলায় চিট ফান্ডের মালিকেরাও অবলীলায় এম পি হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে লোকে আপনাকেও গুলিয়ে ফেলুক, এমনটা কখনই চাই না। এম পি পরিচয়টাকে আমরাও ভুলতে চাই। মনে রাখতে চাই সেই মাথা উঁচু রাখা মানুষটাকে। সেই মানুষটাকে আবার ফিরিয়ে দিতে পারবেন না !