বারবার সুযোগ এসেছে। কখনও নিজের সিদ্ধান্তে, কখনও অন্যের বুদ্ধিতে, বারবার সেই সুযোগ ফিরিয়ে দিয়েছেন। পরে বোঝা গেছে, সেই সিদ্ধান্তগুলো নিতান্তই ভুল ছিল। নিজেও বারবার আক্ষেপ করেছেন। সেদিন ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে উত্তম হয়ত ‘সর্বোত্তম’ হয়ে উঠতেই পারতেন। লিখেছেন সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি।
বাঙালির ‘মহানায়ক’ তিনি। সব বয়সের মানুষের কাছে ম্যাটিনি আইডল। তা সত্ত্বেও কেন বলিউডে গিয়ে নিজের স্থায়ী জায়গা তো দূরের কথা, সেভাবে দাগ কাটতেই পারলেন না। নিজের ক্যারিয়ারে প্রায় ২৩০ টি ছায়াছবিতে মূলতঃ নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেও বরেণ্য বাঙালি পরিচালকদের সঙ্গে সেভাবে কাজ করার সুযোগ পেলেন না কেন? শেষ সময়ে নায়কের ভূমিকা ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন চরিত্রাভিনেতার ভূমিকা। কিন্তু অধিকাংশ ছায়াছবিই বাণিজ্যিকভাবে সফল নয়। কেন? একটু তলিয়ে দেখা যাক এইসব প্রশ্নের উত্তরগুলো।
আসলে উত্তম কুমার তাঁর অভিনয় জীবনের বিভিন্ন বাঁকে এসে নানা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সব যে এককভাবে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল, এমন নয় যদিও। তবে যে কোনও ভুল সবসময়ের জন্যই ভুল। অনেকে সময়ের দোহাই দিয়ে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পরে আক্ষেপ করতেই হয়। উত্তমকুমারের অভিনয় জীবনেও তেমনটাই হয়েছিল। একেবারে শুরুর দিকে প্রায় ১৫–১৬ টি ছবি বাণিজ্যিকভাবে চূড়ান্ত ব্যর্থ হওয়ার পরে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের চাকুরিরত অরুণ কুমার চট্টোপ্যাধ্যায় মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। বাংলার অভিনয় জগতে তখন নায়কের ভূমিকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিকাশ রায়, অসিতবরণ, রবীন মজুমদার প্রমুখেরা। এই কঠিন সময়ে সুধীর মুখার্জির “শাপমোচন” ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেলেন অরুণ কুমার ওরফে উত্তমকুমার। বিপরীতে সুচিত্রা সেন। তিনিও তখন নবাগতা। এই যুগল এর আগে নির্মল দে পরিচালিতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে অভিনয় করলেও সেখানে কিন্তু নায়ক-নায়িকার রোমান্টিসিজমের তেমন পরিসর ছিল না। বরং, অনেক বেশি হাসির ছবি। সেটা যত না উত্তম–সুচিত্রার, তার থেকে ঢের বেশি বোধ হয় তুলসী চক্রবর্তী–মলীনা দেবীর ছবি। তার পর ১৯৫৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বসু পরিবার’ এও নায়ক–নায়িকার জুটি সেভাবে দানা বাঁধেনি। এর পর এল ‘শাপমোচন’। এই ছবিতে উত্তম কুমারের লিপে গান করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আশ্চর্য মিল পাওয়া গেল এই দুজনের কণ্ঠস্বরে। উত্তম কুমার নিজে প্রথাগত ভাবে গান শিখেছিলেন বলেই অসাধারণ লিপ দিলেন ‘শাপমোচন’–এর গানগুলোতে। বাংলা ছবিতে শুরু হল এক নতুন নায়ক–গায়ক জুটির জয়যাত্রা। তার সঙ্গেই সুচিত্রা সেনের সঙ্গেও তৈরি হল এক রোমান্টিক জুটির জয়যাত্রা। সুচিত্রার লিপে গান করতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সার্বিকভাবেই উত্তম–সুচিত্রা এবং হেমন্ত–সন্ধ্যা হয়ে উঠলেন একে অপরের পরিপূরক। শাপমোচনের পরে অগ্নিপরীক্ষা, সবার উপরে, পথে হলো দেরী, শিল্পী, চাওয়া পাওয়া, সূর্যতোরণ, ইন্দ্রাণী, হারানো সুর, সপ্তপদী– এসব একের পর সুপারহিট ছবি। উত্তম–সুচিত্রা জুটি তখন বাংলা ছবিতে সোনা ফলাচ্ছে। একের পর এক। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একের পর এক মনমাতানো গান করছেন উত্তমের লিপে। সার্বিকভাবেই উত্তমের অভিনয় জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল।
এরপর আসি ভুলের কথায়। উত্তমকুমারের ভুলের সূত্রপাতটাও কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ডাকে সাড়া না দিয়েই। প্রথমতঃ মৃণাল সেনের “নীল আকাশের নীচে” তে চীনা ফেরিওয়ালার চরিত্রে কাজ করতে রাজি হয়েও পরে পিছিয়ে যান। শোনা যায়, চীনাদের আদবকায়দা রপ্ত করার মতো সময় ছিল না। ওই চরিত্রের জন্য নাকি প্রায় তিন ঘণ্টার মেক আপ করতে হত, মহানায়কের ব্যস্ত সিডিউলে এত সময় কোথায়! ফলে, এই ছবির কাজটা ছাড়তে হয়েছিল। ছবির প্রযোজক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। উত্তম কুমারের পরিবর্তে সেই চীনা ফেরিওয়ালার চরিত্রে নেওয়া হয়েছিল কালী ব্যানার্জিকে। বাকিটা ইতিহাস। ‘নীল আকাশের নীচে’ শুধু বাণিজ্যিকভাবেই সফল নয়, তা নবাগত পরিচালক মৃণাল সেনকেও পায়ের তলায় দিয়েছিল শক্ত মাটি। উত্তম এই ছবিতে অভিনয় না করে মৃণাল সেনের সঙ্গে দারুণ একটি ছবিতে কাজ করার সুযোগ হারিয়েছিলেন। তার আগে অবশ্য উত্তম কুমার মৃণাল সেনের পরিচালক জীবনের প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ এ অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু সিনেমাটা একেবারেই চলেনি। ‘নীল আকাশের নীচে’ তে কাজ না করার পরে আমৃত্যু উত্তম কুমার আর মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাননি, এমনকি সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’– অভিনয় করে “মহানায়ক” হওয়ার পরেও।
এর পরের ভুলটা আরও মারাত্মক। বাংলা ছবিতে হেমন্ত–উত্তম জুটি তখন জনপ্রিয়তা ও সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। আর বাংলার বাইরে সুদূর আরবসাগরের তীরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ওরফে হেমন্তকুমার তখন হিন্দি ছবির জগতে অন্যতম সফল কন্ঠশিল্পী এবং সঙ্গীত পরিচালক। এই অবস্থায় হেমন্ত ভেবেছিলেন গান গাওয়া এবং সুরারোপ করার পাশাপাশি ভাল মানের ছবি প্রযোজনা করবেন। ‘গীতাঞ্জলি পিকচার্স’ নামে এই সংস্থা ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রযোজক সংস্থার নাম। এই সংস্থার প্রথম ছবি ঠিক হয়েছিল ‘শর্মিলা’। যাতে হেমন্ত চেয়েছিলেন উত্তম কুমারকে। কথাবার্তাও পাকা হয়ে গিয়েছিল। সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে পাতাজোড়া ঢাউস বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এই ছবি থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেন, উত্তম কুমার তখনই হিন্দি ছবিতে কাজ করার জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিলেন না। অনেকে মনে করেন, উত্তম কুমার প্রযোজক হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে তেমন ভরসা করতে পারেননি। যদি ছবি ফ্লপ হয়, তাহলে তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে। যে কারণেই হোক, এই ভুলের খেসারত দিতে হয়েছিল তাঁকে আমৃত্যু। উত্তম আচমকা নিমরাজি হওয়ায় প্রযোজক হেমন্তর বিশাল আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। দুজনের সম্পর্কেও কিছুটা চিড় ধরেছিল। শেষমেষ ‘শর্মিলা’ ছবিটাই আর হল না। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পরে তাঁর প্রযোজনায় তৈরি করলেন ‘বিশ সাল বাদ’। সেটি ছিল অজয় করের ‘জিঘাংসা’র হিন্দি ভার্সান। নায়ক হিসেবে প্রথমে উত্তম কুমারকে ভেবে রাখলেও “শর্মিলা” র ঘটনার পরে উত্তমকুমারের পরিবর্তে নিয়ে এসেছিলেন আরেক বাঙালি নায়ক বিশ্বজিৎ–কে। ‘বিশ সাল বাদ’ এর অভাবনীয় সাফল্য বিশ্বজিৎ–কে বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বাঙালি নায়ক হিসেবে। পরে হেমন্ত প্রযোজিত ‘কোহরা’, ‘বিবি আউর মকান’ ছবিতে বিশ্বজিৎ যেমন নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, তেমনি আরও অনেক অবাঙালি পরিচালকেরও ডাক পেয়েছিলেন তিনি। যে জায়গাটা উত্তমকুমার অনায়াসেই নিতে পারতেন। অভিনয় দক্ষতায়, গ্ল্যামারে সবেতেই তিনি বিশ্বজিতের থেকে অনেক এগিয়ে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে আরবসাগরের তীরে তাঁর চমকপ্রদ উত্থান হতেই পারত। হল না তাঁর হঠকারী সিদ্ধান্তে। পরে ৬০ এর দশকের শেষের দিকে তিনি নিজের প্রযোজনায় যখন ‘ছোটি সি মুলাকাত’ ছবিতে অভিনয় করলেন, সে ছবি একেবারেই চলল না। তার আগে অবশ্য আরেকবার সুযোগ এসেছিল সুপারস্টার রাজ কাপুরের হাত ধরে। ‘সঙ্গম’ ছবিতে রাজসাহেব চেয়েছিলেন উত্তমকুমারকে । তাঁর ঘনিষ্ঠজনেদের মন্ত্রণাতে উত্তমকুমার রাজি হননি কাজ করতে। কারণ, তাঁকে বোঝানো হয়েছিল ছবি হিট করলে সবাই রাজ কাপুরকেই কৃতিত্ব দেবে। কারণ মুখ্য নির্মাতা তিনিই। আর ছবি সফল না হলে দায় নিতে হবে উত্তম কুমারকে। কারণ, বলিউডে তিনি একেবারেই নবাগত। সেবারেও নিজেকে হিন্দি ছবিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারিয়েছিলেন উত্তম কুমার।
বাংলা ছবিতেও এরকম ছোটখাট ভুল তিনি করেছিলেন বৈকি! মাঝে অবশ্য সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করে তিনি খ্যাতির শীর্ষে তখন। কিন্তু বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায় তারপরে ‘চিড়িয়াখানা’ ছাড়া আর কোনও ছবিতেই উত্তম কুমারকে দিয়ে কাজ করালেন না। অবশ্য ‘নায়ক’ পরবর্তী কোনও ছবিতেই উত্তম কুমার মানানসই ছিলেন না। কিন্তু যে তপন সিংহের সঙ্গে উত্তম কুমার ‘জতুগৃহ’ বা ‘ঝিন্দের বন্দী’র মতো ছবিতে অসাধারণ কাজ করেছিলেন, তাঁর ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ছবিতেও দ্বৈতভূমিকায় অভিনয় করার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের মতো প্রবাদপ্রতিম পরিচালককে একেবারেই পাননি উত্তম কুমার। অজয় করকে পেয়েছিলেন পাঁচের দশক থেকে ছয়ের দশকের শুরুতে ‘সপ্তপদী’ পর্যন্ত। তারপর অজয়বাবুর ভাবনায় শুধুই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অসিত সেনের সঙ্গেও সর্বসাকুল্যে একটিমাত্র ছবি ‘জীবনতৃষ্ণা’। আর সাতের দশকের শেষে খ্যাতনামা পরিচালক তরুণ মজুমদারের ‘সংসার সীমান্তে’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন উত্তম কুমার তাঁর গ্ল্যামার নষ্ট হওয়ার কারণ দেখিয়ে। অথচ জীবনের শেষ ৮ বছর অনেক কম বাজেটের ছবিতে কাজ করে গিয়েছিলেন। অখ্যাত অনেক পরিচালকের ছবিতে এমন সব চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যা তাঁকে একেবারেই মানায় না। বিশেষ করে ১৯৭৫–১৯৮০ এই ৫ বছরে উত্তমকুমারের স্মরণীয় অভিনয় বলতে ‘অগ্নীশ্বর’ এবং ‘অমানুষ’। আর শারীরিক কারণেও তিনি তাঁর মধ্যবয়সের রুপলাবণ্য হারিয়েছিলেন। সেজন্যই হয়ত হাতের কাছে যা পেয়েছিলেন, সেখানেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন।
যা তিনি পেয়েছিলেন তার থেকে অনেক বেশি উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে যেতেই পারতেন। অসম্ভব ভাল ছিলো তাঁর সাঙ্গীতিক বোধ। গানে লিপ দিতেন একেবারে ছবির সেই সিচুয়েশনের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে। এই কারণেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, কিশোর কুমার থেকে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, ভূপেন হাজারিকা এমনকি হিন্দি ছায়াছবিতে মহম্মদ রফির গান ও তাঁর লিপে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে বরেণ্য পরিচালক দের সঙ্গে সেভাবে কাজ করার সুযোগ পাননি কিছু ভুল সিদ্ধান্তে। একই কারণে বলিউডেও বাঙালির অভিনয় প্রতিভার সাক্ষর রাখতে পারেননি। ‘সর্বোত্তম’ হওয়ার সুযোগ গুলো নিজেই হারিয়েছিলেন নানা জ্ঞাত–অজ্ঞাত কারণে, যা আজও সিনেমাকুশলী ও তঁার অগণিত ভক্তদের কাছে রহস্যে ঢাকা।
****
বেঙ্গল টাইমসের মহানায়ক স্পেশাল।
আস্ত ই–ম্যাগাজিন। রয়েছে নানা আঙ্গিকের ১৮ টি লেখা।
পড়তে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন। প্রচ্ছদের ছবিতেও ক্লিক করতে পারেন। তাহলেও পুরো ম্যাগাজিনটি খুলে যাবে।
https://www.bengaltimes.in/BengalTimes-MahanayakSpecial.pdf
