নন্দ ঘোষের কড়চা
(নন্দ ঘোষের কড়চা। বেঙ্গল টাইমসের জনপ্রিয় একটি বিভাগ। নন্দ ঘোষ সবকিছুকেই একটু বাঁকা চোখে দেখেন। তাঁর সমালোচনার হাত থেকে কারও নিস্তার নেই। তিনি নতুন নতুন টার্গেট খুঁজে নেন। পাহাড়ে বরফ নিয়ে চারিদিকে যখন সেলফি আর রোমাঞ্চের হুড়োহুড়ি, তখন হাওয়া অফিস আর কাগজওয়ালাদের একহাত নিলেন চিরনিন্দুক নন্দ ঘোষ।)
অনেককাল আগে রাজেন গোলদার নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন। বেচারাকে কী গালমন্দই না হজম করতে হয়েছে! এমনকি তিনি অবসর নেওয়ার পরেও রেহাই মেলেনি। সবজান্তা বাঙালি আপন মনে গালাগাল দিয়ে গেছেন। নামই হয়ে গিয়েছিল রাজেন গুলদার।
ভদ্রলোকের দোষ কী? তেমন আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। এত উন্নত প্রযুক্তি ছিল না। তাই, ঝড়–বৃষ্টির কথা এখনকার মতো এত ভাল বোঝাও যেত না। তাই অনেকসময় তাঁর দেওয়া পূর্বাভাস মিলত না। যেদিন বলা হত বৃষ্টি হবে, লোকে ছাতা নিয়ে বেরোলো, দেখা গেল খটখটে রোদ। আবার যেদিন বলা হল আবহাওয়া পরিষ্কার, সেদিন হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে গেল। শেষদিকে লোকে বলতে শুরু করল, আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর যেটা বলবে, তার উল্টোটা ধরতে হবে। যদি বলে, বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই, তাহলে অবশ্যই ছাতা নিয়ে বেরোবেন। বেচারাকে নিয়ে এমন কত ্তিরঞ্জন, কত জোকস, কত আষাড়ে গপ্পো চালু আছে।
সেই রাজেন গোলদার আর নেই। নিশব্দে মারা গিয়েছেন। দু–একটা কাগজে ছোট্ট করে খবর বেরিয়েছিল। অনেকের চোখেও পড়েনি। কিন্তু আবহাওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি থেকেই গেছে। এখন অসময়ের বৃষ্টিও আগাম বলে দেওয়া যাচ্ছে, এটা ঘটনা। কিন্তু অন্যরকম বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। মাঝে মাঝেই বলা হয়, এটা এ বছরের শীতলতম দিন। কখনও বলা হয়, সতেরো বছরে নাকি এরকম ঠান্ডা পড়েনি। কখনও বলা হয়, ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে এমন শীত নাকি শেষ ৫৭ বছরে পড়েনি। অনেকটা ক্রিকেটের মতো। যাই করুন, কিছু না কিছু একটা রেকর্ড ঠিক দেখিয়ে দেবে। ধরা যাক, কোনও ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করল। বলা হবে, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তৃতীয় দিন কোনও বাঁ হাতি এত রান করেননি। নইলে বলা হবে, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে কোনও ব্যাটসম্যান নিজের ৫৭ তম টেস্টে চার মেরে শতরান করেননি। অর্থাৎ, কোনও না কোনও দিক থেকে এটা যে রেকর্ড, আপনার মাথায় সেটা ঢুকিয়েই ছাড়বে। আবহাওয়া দপ্তরও তেমনটাই শুরু করেছে।
দার্জিলিংয়ে বরফ পড়ার পর বলতে শুরু করেছে, গত এগারো বছর নাকি বরফ পড়েনি। কয়েকদিন আগেই সান্দাকফুতে বরফের বিশাল ছবি সব কাগজে ছাপা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে অন্তত চল্লিশবার কাগজে বরফ পড়ার খবর হয়েছে। কখনও ভোরবেলায় গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির হয়ত কিছুটা জমেছে, ব্যাস, সেটাকে বরফ বলে চালিয়ে দেওয়া হল।
হ্যাঁ, দার্জিলিং যে উচ্চতায়, সেই সাত হাজার ফুটে ঘন ঘন বরফ পড়ার কথাও নয়। কিন্তু কলকাতায় যাঁরা কাগজের হেডলাইন করেন, তাঁরা সারা জীবনে একবার পাহাড়ে গেলেও নিজেদের বিরাট পাহাড়–বোদ্ধা ভাবতে ভালবাসেন। তাই, তাঁদের কাছে ছাঙ্গু আর গ্যাংটকের বিশেষ তফাত নেই। তাঁদের কাছে সান্দাকফু আর দার্জিলিংয়েরও ফারাক নেই। তাই মাঝে মাঝেই তাঁরা দার্জিলিংয়ে বরফ–এই মর্মে ছবি ছাপেন। হেডিং করেন। এরকম হেডিং গত পাঁচ বছরে কতবার যে বেরিয়েছে! পুরনো ফাইল ঘাঁটুন। অন্তত পঞ্চাশবার এরকম হেডিং ও ছবি আপনার চোখে পড়বে।
এখন তো আবার ফেসবুকের সৌজন্যে নানা ছবি ভাইরাল হচ্ছে। বিদেশের ছবিকে সিকিম বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, সিকিমের ছবিকে দার্জিলিং বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে, বিভ্রান্তিটা আরও বেড়েছে। আর আবহাওয়া দপ্তরও এই বিভ্রান্তি দূর করার তেমন চেষ্টা করেনি। ঠান্ডা পড়লে, গরম পড়লে, তাঁরা নিজেদের প্রাসঙ্গিক মনে করেন। তাঁরাও বুঝিয়ে ছাড়েন, এখন যেটা হচ্ছে, আগে হয়নি। ফলে, তখন যা যা গুজব ছড়ায়, তাতে তাঁরাও হাওয়া দেন। এঁরা কিন্তু গোলদারবাবুদের থেকেও মারাত্মক।
একটা জিনিস কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। বারো বছর পরেই যদি বরফ পড়ল, তাহলে এত দিনের এত বরফের খবর সব ফালতু! সব ভুয়ো! ভুয়ো ডাক্তার নিয়ে এত এত প্রতিবেদন হল, এদিকে কাগজওয়ালারা ভুয়ো বরফ দিনের পর দিন দেখিয়ে গেলেন! তাহলেই বুঝুন, এই সবজান্তারা সব খবরে কতটা বরফ মেশায়।