এমন সিদ্ধান্ত মেরুকরণকেই উস্কে দেয়

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
কলকাতা পুরসভার মেয়র পদে আসীন হতে চলেছেন ফিরহাদ হাকিম। তৃণমূল নেত্রী তথা বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তেই তিনি মেয়র হচ্ছেন, তা বলাই বাহুল্য। নইলে তিনি কোনও ওয়ার্ডের বিজয়ী কাউন্সিলরও নন। তাঁকে মেয়র করার জন্য বিধানসভায় বিল এনে নতুন আইন তৈরি করতে হল। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর হাতে সুব্রত মুখার্জির মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ, যাঁর কলকাতা পুরসভার মেয়র হওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁকে বাদ দিয়ে ফিরহাদ হাকিম কেন? তিনি কি শুধু তার দলনেত্রীর আস্থাভাজন বলে ? নাকি তাঁর নাম বাছার পেছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে ?
একটু তলিয়ে দেখলেই উদ্দেশ্যটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায়। আর মাস ছয়েক পরেই লোকসভা নির্বাচন। আর সেই লোকসভা ভোটের কথা ভেবেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এই সংখ্যালঘু তাস খেলা। একেই তাঁর সাত বছরের শাসনাধীনে সংখ্যালঘুদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব সীমাহীন উচ্চতায় উঠেছে। হিন্দু রীতিনীতি পুজো–‌পার্বণে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনা জায়গায় জায়গায় অনেক ঘটেছে। কোথাও দুর্গাপূজাতে বাধা দেওয়া, কোথাও রাতের অন্ধকারে কালীমূর্তির মাথা ভেঙে নিয়ে চলে যাওয়া, কোথাও বা স্কুল–‌কলেজে সরস্বতী পুজো করতে বাধা দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা ঘটছে। আর এইসব ঘটছে বস্তুতঃই মুখ্যমন্ত্রীর সংখ্যালঘু তোষণ বা সেই সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ “বদান্যতা” র কারণে। তাই ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে সংখ্যালঘু নেতা ত্বহা সিদ্দিকি এই কথা বলার ঔদ্ধত্য দেখানে পারেন যে, ‘‌বাংলায় কারা সরকার গড়বে, তার নির্ণায়ক হব আমরা (সংখ্যালঘুরা)।’‌ গত সাত বছরে উদাহরণের অভাব নেই। মুসলিম সম্প্রদায়ের সত্যিকারের উন্নয়ন হলে আপত্তির কিছু ছিল না। কিন্তু ভোটের স্বার্থেই এই সম্প্রদায়কে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে কোনও রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছেই বিষয়টা পরিষ্কার। বাংলার বিভিন্ন জেলায় ইদ্রিশ আলি, আরাবুল ইসলাম, মণিরুল ইসলামদের দাপট প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়।

firhad hakim

মেয়র নির্বাচনেও মুখ্যমন্ত্রী আদপে সেই সংখ্যলঘু তাসই খেললেন। আর তা খেললেন আসন্ন লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখেই। তাই সুব্রত মুখার্জির মতো পূর্ব অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নেতা বা “স্নেহধন্য” অরূপ বিশ্বাস নয়, মেয়র হিসেবে তিনি বেছে নিলেন এক “সংখ্যালঘু মুখ” কেই। আর বেছে নেওয়া যে অন্যদিকে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি–‌কে সাম্প্রদায়িক তাস খেলতে আরও উৎসাহিত করবে, তা বলাই বাহুল্য। এমনিতেই বিজেপি–‌র হাতে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে “হিন্দুত্ব” ছাড়া আর কোনও ইস্যু নেই। সাম্প্রতিক অযোধ্যার ছবি দেখলেই তা পরিষ্কার হয়। আর বিগত সাড়ে চার বছর ধরে গোটা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে যে “হিন্দুত্বের” আগ্রাসন চলছে, বিভিন্ন রাজ্যে সেই ছবিটা পরিষ্কার। এক্ষেত্রেও উদাহরণের ফিরিস্তি বাড়িয়ে লাভ নেই। বাংলাতেও তার প্রভাব পড়েছে বেশ ভালমতোই। আসানসোল বা বাদুড়িয়া সাম্প্রদায়িক হিংসা ও অশান্তি দুই সম্প্রদায়ের “সম্প্রীতি” তে আঘাত হেনেছে। “রামনবমী” র মিছিলে কিশোর পড়ুয়াদের হাতে ত্রিশূল বা দা নিয়ে হিংস্রতার ছবিও বাংলায় দেখা গেছে, যা বিগত বাম জমানায় অভাবনীয় ছিল। বাংলার মু্খ্যমন্ত্রীর এই মেয়র নির্বাচন যে বাংলাতেও বিজেপিকে আরও “হিন্দুত্ববাদে” মদত জোগাবে, তা বলাই যায়। তৃণমূল নেত্রী তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর লক্ষ্য যেমন রাজ্যের ২৭% মুসলিম ভোট পাওয়া, তেমনি বিজেপির–‌ও লক্ষ্য বাংলা তথা গোটা ভারতবর্ষেই হিন্দু ভোটকে একত্র করা। দুই দলের এই ধর্মীয় মেরুকরণই লোকসভা ভোটের আগে বাংলা তথা ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে কলুষিত করার পক্ষে একেবারে আদর্শ।
নির্বাচনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মেয়র নির্বাচন করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘুদের আরও একবার “দোয়া” দেখিয়ে পরোক্ষে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আরও আগ্রাসী হতেই সাহায্য করলেন। এই ধর্মীয় মেরুকরণই রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশকে তিলে তিলে নষ্ট করছে। মুখ্যমন্ত্রীও এর দায় অস্বীকার করতে পারেন না। বিভিন্ন সভায় তিনি রবীন্দ্রনাথ–‌নজরুলের কবিতা আউড়ে যান। সেগুলো তখন বড়ই মেকি মনে হয়।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.