সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
পুড়েছে তো কুশপুতুল, তবুও ‘অগ্নিকন্যার’ মনে ভয়,
কার এত দুঃসাহস? হোক তবে কারাগারে আশ্রয় ।
হেথায় তথাকথিত বিদ্বজ্জন আর সুশীল সমাজ,
“শ্রী”,“বিভূষণে” মেরুদণ্ড বন্ধক রেখেছে আজ,
ওই প্রতিবাদিনীর দুটো চোখেই তাই দেখেছি দৃপ্ত প্রত্যয় |।
দেবীপক্ষের আগমন ঘটেছে। উৎসব প্রিয় বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা সমাগত। চারিদিকেই দুর্গোৎসব কে ঘিরে আবাল-বৃদ্ধ বনিতার মধ্যে স্বভাবসিদ্ধ প্রাণময়তা। এমনি সময়েই শিলিগুড়ির এক তরুণী পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার। তার অপরাধ কি ? সে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে প্রকাশ্যে। কারণ সে দাঁড়িভিটের স্কুলে যে দুজন ছাত্র শিক্ষকের দাবীতে আন্দোলন করে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে তাদের বিচারের দাবীতে রাস্তায় নেমেছিল। তরুণীটির আরও পরিচয় আছে। সে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।
বস্তুতঃ এই ঘটনা এখন আর “শান্তিপ্রিয়” বাঙালির “নিস্তরঙ্গ জীবনে” কোনও ঢেঊ বা প্রবাহের সৃষ্টি করে না। কারণ এক শ্রেণীর মানুষ বর্তমানে উৎসবের আবহে এই ঘটনাকে “তুচ্ছ” বা “অপ্রয়োজনীয়” ভেবে উদাসীন। তাঁরা হয়ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর হাতে বিভিন্ন পূজামণ্ডপে ফিতে কাটা আর উদ্বোধনী দেখতেই ব্যস্ত হয়ে আছেন। আর একটু যাঁরা রাজনীতি বা অন্তত সমাজ-সচেতন বলে নিজেদের দাবি করেন, অবসর সময়ে বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়ের সঙ্গে চায়ের আড্ডায় রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে একটু-আধটু আলোচনা করেন, তাঁদের অধিকাংশই হয়ত এই ঘটনাতে “মৌনব্রত’ অবলম্বন করাই শ্রেয় মনে করেন। কারণ সেই তরুণীটি তো তাদের কারও মেয়ে বা বোন বা কোনো আত্মীয়া নন ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই ঔদাসীন্য,এই আত্মকেন্দ্রিকতাই কিন্তু আসলে একটি স্বৈরাচারী সরকারকে বারংবার এই নগ্ন স্বৈরাচার চালিয়ে যেতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মদত দিচ্ছে। একবার ভাবুন, সুকৃতী আঁশ নামে সেই মেয়েটি আপনাদের বাড়ি বা পরিবারের কেউ নয় ঠিকই, কিন্তু তার দাবিটা কী ছিল ? কোচবিহারের দাঁড়িভিট স্কুলে বাংলার শিক্ষক চেয়ে যে দুজন ছাত্র পুলিশের গুলিতে মারা গেল, সেই ছাত্র দুজনের হত্যার বিচার চেয়ে সে পথে নেমেছিল। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এসব ঘটনার ধার ধারেন না, তাঁর তখন অনেক বড় কাজ পড়েছিল। যেমন শিল্প আনার নাম করে জার্মানি ভ্রমণে যাওয়া, ফিরে এসে দুর্গাপূজ়ার নামে কয়েকশো ক্লাবকে সরকারি অনুদান দিয়ে তাদের পায়ের তলায় এনে ফেলা এবং ভোটের সময় তাদের যথেচ্ছভাবে ভোট লুট করতে মদত দেওয়া বা পুজোর উদ্বোধনী সঙ্গীত রচনায় মেতে থাকা। তিনি তো তিন তুলির টানে ছবি আঁকতে পারেন, যা কিনা ১ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকায় বিকোয়, তেমনি বাগডোগরা বিমানবন্দরের বাথরুমে বসে ১ মিনিটে তিনি গান লেখা এবং সুর করে ফেলতে পারেন ! এতই তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভা! বাম সরকারের আমলে নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুরের পরে তিনি যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তখন তাঁর নেতৃত্বে বাংলার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কুশপুত্তলিকা কতবার পোড়ানো হয়েছিল, তা মনে হয় তিনি ভুলে গেছেন । সেই পুলিশকে দিন নিজের পায়ের তলায় এনে “ক্রীতদাস” বানিয়ে রেখেছেন। তাঁর দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে যে পুলিশ “নপুংসকের” ন্যায় প্রাণ বাঁচাতে টেবিলের নীচে আত্মগোপ্ন করে থাকে, সেই মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করতে দেখলেই যেন কীসের “মন্ত্রবলে” সে “মৃতপ্রায়” আইনের রক্ষকদের মধ্যে “সঞ্জীবনী”র সঞ্চার হয়! তখন সেই “বীরপুঙ্গব” রা অতিসক্রিয় হয়ে বাম ছাত্র-যুব, যুবতী, কর্মীদের ওপর নিজেদের বীরত্ব ফলাও করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বিগত পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে কাকদ্বীপে ভোররাতে নিজের বাড়িতে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিলেন দেবু দাস ও তাঁর স্ত্রী ঊষারাণী দাস। তাঁদের পরিচয় ছিল তাঁরা দুজনেই বাম কর্মী। আজও সেই “সুপরিকল্পিত হত্যা” র কোনও কিনারা হয়নি। বরং পুলিশ সেটিকে “আত্মহত্যা” বা “দুর্ঘটনা” বলেই রিপোর্ট দিয়েছে। একইভাবে দাঁড়িভিট স্কুলে যে দুজন ছাত্র পুলিশের গুলিতে মারা গেল, হয়ত তাদের পরিবারও কোনওদিনই সুবিচার পাবে না। আর সেই সুবিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুল পুড়িয়ে পুলিশি হেফাজতে এক প্রতিবাদী তরুণী ! আইনের রক্ষকরা আবার তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করেছে।
সমাজটা কোন দিকে চলেছে ? একটা দমবন্ধ করা পরিবেশের মধ্যে আমরা বাস করছি। এখানে বিরুদ্ধাচরণ করলেই কখনও “মাওবাদী”,কখনও “দেশদ্রোহী” এসব তকমা দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রের চোখে তখন তারা “দ্রোহী”। সেখানে অম্বিকেশ মহাপাত্র, শিলাদিত্য সেন থেকে গৌরী লঙ্কেশ বা নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন—সব বিরুদ্ধাচারীরাই এই স্বৈরতন্ত্রের আক্রমণের শিকার। আজ যে স্বৈরতন্ত্রের আগুন আপনার অপরিচিত ছেলে বা মেয়েকে গ্রাস করছে, কাল তাতে আপনি বা আপনার ছেলে-মেয়েও “দগ্ধ” হতে পারেন, সে আপনি “উদাসীন” ই থাকুন বা “মৌনব্রত” ই পালন করুন। সুতরাং সময় এসেছে এই বিষবাষ্পাকূল পরিবেশ থেকে পরিত্রাণের পথ খোঁজ়ার। তাই প্রতিবাদে সামিল হোন। এই উৎসবের মাঝে সুকৃতী আঁশের সমর্থনে অগ্রণী হোন। “সুকৃতী” রাই এই “বধ্যভূমি” থেকে দিন বদলের লক্ষ্যে অভ্রান্ত সৈনিক।