টিভির বাইটে যে সংলাপ ছিল না

রুমা ব্যানার্জি

(‌নদীটি হতে পারে আত্রেয়ী বা মহানন্দা। স্থান মালদহ বা বালুরঘাট বা রায়গঞ্জ০।
কূল ছাপিয়ে বয়ে চলেছে জলের স্রোত। প্রাণ বাঁচাতে নিজের যৎসামান্য জিনিস পোঁটলা বেঁধে উঠে গেছে কাছের স্কুলে, বা কাছের রেল লাইনের ধারে। কেউ ত্রিপল পেয়েছে, অনেকই পায়নি।
এক বুক জলে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে জনৈক সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হতেই — “রোল ক্যেমেরা। ১ ২ ৩”

চিত্র ১●
সাংবাদিকের গলায় বাচিক শিল্পীর আবেগের ছোঁয়া। গলায় modulation টা জরুরি।
‘‌আপনারা দেখছেন কীভাবে জল ঢুকে নিরাশ্রয় করেছে এখানকার সাধারণ মানুষদের। আপনাদের সোজাসুজি শোনাবো তাঁরা কী ভাবছেন।’‌
প্লাসটিক গামলা মাথায় এক মহিলার সামনে মাইক্রো ফোন ধরে –‘‌আপনার ঘরে তো দেখছি সব জলের তলায়। এই বন্যায় আপনার অভিজ্ঞতা, কী করছেন, কী ভাবছেন, যদি একটু আমার দর্শক বন্ধুদের জানান।’‌
— ‘‌খুব অসুবিধার মধ্যে আছি গো বাবু। সব ভেসে যাচ্ছে। কিছু বাঁচাতে পারলাম না।’‌

(যেটা শোনা গেল না— হাড়হাভাতে বজ্জাত। মাইক না এনি চার প্যেকেট মুড়ি আনতে পারলি নে? বন্যাতে ঘরে জল ঢুকেচে। এত সাধের জিনিস সব লষ্ট হতিছে আর ইনি এয়েচেন ছবি তুলতি!‌ বাবুরা দেকে কি ন্যেজ গজাবে? তেনারা তো ঠাণ্ডা ঘরে বচে পা নাচাচেন। খপর দেকে ইস্ উস্ করি চপ কাডলেড গিলবেন। তাপ্পর দেবের গান চালিয়ে হোঁৎকা ভুঁড়ি নাচাবেন। ঝাঁটা মারি অমন পিরীতের মুকে। যত্তোসব। ইদিকে কতা কয়ে দেরি করানো কেন বাপু। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।’‌)‌

banya2

চিত্র ২●
স্থান: বন্যা কবলিত এলাকায় ট্রেনলাইনের ধারে, ত্রিপলও প্লাসটিকের তৈরি অস্থায়ী ছাউনি।
সাংবাদিক :‌ ‘‌আমার সঙ্গী ক্যামেরা–‌পার্সনকে অনুরোধ করছি, একটু এদিকে ক্যামেরাটি ঘুরিয়ে আমাদের দর্শকবন্ধুদের জন্য বন্যা–‌দুর্গত এলাকায় মানুষ কী অসহায়ভাবে দিন যাপন করছে, সেই মর্মস্পর্শী দৃশ্য গুলি দেখানোর জন্য।
ক্যামেরায় ভেসে উঠল গোটা তিনেক পুঁটলি, একটা বালতি, দুটো আদুর গায়ে বাচ্চা, আর এক তরুণী, সে অচেনা লোকেদের দেখে মাথার ঘোমটা টেনে নিল। তারপর ভুলু বা মিনিকে তাড়ানোর ভঙ্গীতে হাত নেড়ে যা যা হুস হুস করে অন্যদিকে ফিরে বসল। বোধহয় মনে মনে বলল— ‘‌ন্যেকা! দেখলে হাড়মাস জ্বলে যায়!‌ ভারি এয়েচন ফটক তুলতি। আর একটা কতা কইলে মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব।’‌

banya3

চিত্র ৩ ●‌
অগত্যা গন্তব্য পরের তাঁবু।
সাংবাদিক:‌ ‘‌দিদি, আপনি কি এই এলাকায় থাকেন? আপনার ঘরে কি জল ঢুকেছে? আপনার অভিজ্ঞতার কথা একটু বলুন। কী খাওয়া–‌দাওয়া করছেন, বাচ্চারা কী খাচ্ছে .. সব বলুন।’‌
মহিলা অতি কষ্ট করে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে বললেন, আরে বাবুজি, পরশো রাতকো দওয়া ছোড়ে ঘর মে পানি ঢুকতে লাগলাম। তো সুবাহ হামার মরদ হামাদের ইহাঁ লাইকে পটক দেইল। তব সে অনন কা এক দানা ভি নসিব না হৈল। বচ্চা ভুখ কে মারে রোয়াত রহৈল। বহুতি পরশানি হো।

(আরে বুরবাক। দিমাগ মা ভুষা ভরা হ্যয় কা? বার আয়া তবৈ হম ইধর আকে ডেরা জমৈ কি নাহি! বাত করত হো। মন মা লাগে কি কান কে নিচে বজায়ে। দে দনা দন। তবৈ জী মা চৈন পরি। জী করতহো কি মুন্নাকো তোহার খুন পিলাকে শান্ত বৈ। শালে ***** কহিঁকা। )

চিত্র: ৪●
সকাল থেকে টিভির সামনে বুঁদ হয়ে আছেন অমুক বাবু। দেশের আজ বড় বিপদ। ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি। পাঁচ কাপ চা, পিঁয়াজি, ফুলকো লুচি, আলু চচ্চরি সাঁটিয়ে সকাল বিকালের খবর দেখছন বসে।
কোন এক টাউনের রাস্তা। সাংবাদিকদের দেখে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসেছেন এলাকার পুরকর্তা। সঙ্গে কিছু চ্যেলা। ক্যামেরা দেখে কিছু আঞ্চলিক লোকজনও জড় হয়েছেন।
নেতা লোকটি একাই স্ক্রিন জুড়ে হাত ছুঁড়ে বলে চলেছেন—‘‌এই অঞ্চলের মানুষের কাছে আমরা আবেদন রাখতে চাই, বিচলিত হবেন না। আমরা সারা বছর আপনাদের সেবা করি। কিন্তু কি করা ? বৃষ্টি–‌ বন্যা তো আমাদের হাতে নেই। এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা। দুদিনের মধ্যে কোমোর জল নেবে হাঁটু জল হয়েছে। আর বৃষ্টি শুরু না হলে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি যে আগামী হপ্তায় এলাকায় জলের চিহ্ন থাকবে না। এটা আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ।
হঠাৎ টিভি চ্যানেলে ভেসে উঠল দিদি নং ওয়ান। অমুক বাবু গিন্নির দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলার সাহস পেলেন না। পরের সংলাপ সবার জানা।
অতএব ……

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.