(ঠিক তিন বছর আগে। রাজ্যের নানা প্রান্তে চলছিল পুরসভার ভোট। সকাল থেকেই বোমা, আর গোলাগুলির শব্দে যেন কেঁপে উঠেছিল বাংলা। টিভিতেও ছিল সেই উত্তাপ। এমনই এক সকালে হঠাৎ ভূমিকম্প। মুহূর্তে পটভূমি যেন বদলে গেল। বেঙ্গল টাইমসে অনেকেই তুলে ধরেছিলেন টুকরো টুকরো নানা মুহূর্ত। আসলে, টুকরো টুকরো জীবনের নানা ছবি। আবার ভূমিকম্প। তিন বছর আগের সেই লেখা আবার তুলে ধরা হল বেঙ্গল টাইমসে। )
নানা চোখে ভূমিকম্প। সেই সময় কে কী করছিলেন ? কে কীভাবে দেখলেন এই ভূমিকম্পকে ?
বেচারা বিজন, পালাবেন না থাকবেন!
রাহুল মিত্র
ঘরে বসে টিভি দেখছিলাম। ভোটের খবর। হঠাৎ দেখলাম, চেয়ারটা কাঁপছে। একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসেছিলাম। বয়স বাড়ছে, ওজনও বাড়ছে। হেলান দিতে গিয়ে আগে দুবার চেয়ার ভেঙেছে। ভাবলাম, এটাও বোধ হয় নড়বড় করছে। ভাঙল বলে!
আবার ভূপতিত হওয়ার আগে চেয়ারটা বদলে নেওয়াই ভাল। এই মনে করে উঠে দাঁড়ালাম। ওমনি এবিপি আনন্দে দেখলাম, সুমন বলছেন, কলকাতায় ভূমিকম্প হচ্ছে, স্টুডিও কাঁপছে, চেয়ার টেবিল কাঁপছে।
বুঝলাম, শুধু আমার চেয়ার নয়, গোটা পৃথিবীটাই বোধ হয় নড়বড় করছে। কী করব ? বেরিয়ে যাব, নাকি টিভির দিকে তাকিয়ে থাকব ? নামার আগেই যা হওয়ার হয়ে যাবে। নামলেও তো গোটা বাড়িটা মাথার উপর হুড়মুড় করে পড়বে। প্লাস, ভিতু হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার একটা আশঙ্কাও থাকবে।
ঠিক তখনই নতুন ভূমিকায় দেখা গেল শ্রীমান বিজন সরকারকে। তিনি বারবার বলে চলেছেন, আমাদের কিন্তু বেরিয়ে যাওয়া উচিত। তিনি বলছেন। কিন্তু সুমন শুনছেই না। সে ভাষণ দিয়েই চলেছে। তবে গলাটা যেন কাঁপা কাঁপা। বিজন কুমার পাঞ্জাবি থেকে মাইক্রোফোনটা খুলতে যাচ্ছেন। সবাই বসে আছেন। একা পালাতেও পারছেন না। তবে বেশ ভয় পেয়ে গেছেন, বোঝা গেল।
মনে মনে বললাম, পালিয়ে যাবে কোথায় ? নামার আগেই সব শেষ। কিন্তু তখন বিজনবাবু এসব ভাবার মতো জায়গায় ছিলেন বলে মনে হয় না।
—
ধন্যবাদ ভূমিকম্প
মহুয়া ভট্টাচার্য
আমি থাকি বেহালায়। প্রথমটায় কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। আমার চার বছরের ছেলেও বোঝেনি। ওর বোঝার কথাও নয়। আমার শাশুড়ি বললেন, আলমারিটা নড়ছে। শুরুতে বিশ্বাস করিনি। পরে বুঝলাম, সত্যিই নড়ছে।
আমরা এক তলায় থাকি। প্রথমে মনে হল, ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে যাই। কিন্তু শাশুড়ি! এই শরীর নিয়ে তিনি তো নামতে পারবেন না। তাঁকে ফেলে রেখে বেরিয়ে যাব ? ব্যাপারটা সত্যিই খুব খারাপ হত। নিজের স্বামীকে কী মুখ দেখাব ? মনে হল, যা হয়, হোক। মরলে সবাই একসঙ্গেই মরব। মায়ের কাছে গিয়ে বসলাম।
মা বলল, যাও, তোমরা নিচে চলে যাও। বললাম, না, আপনাকে একা ফেলে দিয়ে যাব না। যা হয় হোক।
কয়েকদিন ধরেই কিছু কিছু ব্যাপারে মন কষাকষি চলছিল। শাশুড়ি-বউয়ের সম্পর্ক যেমন হয়! যখন থেমে গেল, জানালা দিয়ে দেখলাম, অনেকে রাস্তায় নেমে গেছে। শাশুড়িও সেই দৃশ্য দেখলেন। বললেন, আর ভয় নেই। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
অনেক ভুল বোধাবুঝি, সম্পর্কের মাঝে জমে থাকা অনেক মেঘ যেন এক নিমেশে সরে গেল। দুজনের তখন চোখ ছলছল। আমার চার বছরের ছেলে দেখল, মা আর ঠাকুমা দুজনেই কাঁদছে।
ধন্যবাদ ভূমিকম্প, তুমি অনেক ফাটল ধরিয়েছো। কিন্তু নিজের অজান্তে অনেক ফাটলকে জোড়াও লাগিয়ে দিলে।
——-
কে কতটা বীরপুরুষ, দেখলাম
অম্লান বসু
আমি ছিলাম অফিসে। ডালহৌসি চত্ত্বরে আমার অফিস। বেশ পুরানো বাড়ি। সত্যি বলছি, শুরুতে কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। পাশের টেবিলের ঘটকদাকে দেখলাম, জুতো না পরে খালি পায়েই দৌড়চ্ছেন। তাঁকে দেখে অন্যরাও দে-দৌড়।
বুঝলাম, বোধ হয় ভূমিকম্প হচ্ছে। আমাদের অফিস তিন তলায়। লিফটে নিশ্চিতভাবে হুড়োহুড়ি লাগবে। সিঁড়ি দিয়ে এত দ্রুত নামতে পারব না, তাও জানি। কিন্তু সত্যি বলছি, সবাই যখন পালাচ্ছে, তখন বসে থাকার মতো সাহস আমার ছিল না।
আচমকা এমন কিছু মুহূর্তেই তো বোঝা যায়, কে কতটা ভীতু, কে কতটা সাহসী। কেউ দুঃখ পেতে পারেন ভেবে সব অভিজ্ঞতার কথা লিখছি না। তবে সত্যিই দারুণ এক অভিজ্ঞতা হল। যাদের খুব সাহসী বলে জানতাম, দেখলাম তারা সবার আগে দৌড় লাগাল।
ভয় পেতেই পারে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুশকিলটা হল, কেউ কেউ স্বীকার করতে পারে না। নিচে নেমেও তাদের বাতেলা যায় না। একজন তো বলে বসল, রাস্তা থেকে এই কাঁপুনিটা কেমন দেখতে লাগে, সেটা দেখতে নাকি সে নেমে এসেছে।
বডি খুঁজেও পাওয়া যাবে না!
তরুণ রায়
আমি তখন মেট্রোতে। এমনিতেই ট্রেনে কাঁপুনি। তাই কিছু বুঝতে পারিনি। নামলাম সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে তখন ট্রেন ধরার জন্য অনেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেখলাম, হঠাৎ সবাই ছোটাছুটি করছে। তখনও বুঝতে পারিনি।
বরং, মনে মনে তাদের গালমন্দ করছিলাম, এত তাড়াহুড়োর কী আছে ? বাচ্চা ছেলের মতো এত ছোটাছুটির কী আছে? একজন বলল, ভূমিকম্প হচ্ছে। বাইরে বেরোতে হবে। আমাকে পেছন থেকে অনেকে ধাক্কা মারল। আমিও ছুটতে লাগলাম।
এই সময় মাইকে ঘোষণা, বাইরে প্রবল ভূমিকম্প। আপনারা বাইরে বেরিয়ে যান। এতে আরও বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। সবাই বাইরে বেরিয়ে এলাম। ততক্ষণে অবশ্য থেমে গেছে। যাক, হাফ ছেঁড়ে বাঁচলাম।
যাদের মেট্রোতে যাওয়ার কথা ছিল, তাদের কেউ কেউ দেখলাম, হাত বাড়িয়ে ট্যাক্সি থামাচ্ছে। এক মহিলাও ট্যাক্সি থামাচ্ছে। সঙ্গে থাকা তার বন্ধু বলল, চল, থেমে গেছে। সেই মহিলা, বলল, মাটিতে চাপা পড়লে লাশটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার থেকে অ্যাক্সিডেন্টে মরা অনেক ভাল।
ভূমিকম্প ও আমাদের ‘ফেসবুকরত্ন’
ভিক্টর বিশ্বাস
থাকি যাদবপুরের একটা মেসে। পড়াশোনা করি। আজ ইউনিভার্সিটি ছুটিই ছিল। মানে, ক্লাস ছিল না। বেশ বেলায় উঠি। আজ তাড়া না থাকায় উঠেছি আরও দেরিতে।
পাড়ার দোকানে চা খেয়ে, টিফিন করে ঘরে ঢুকেছিলাম। টিভিতে একবার ভোটের খবর। শুধু মারামারি আর সন্ত্রাস দেখতে ভাল লাগল না। একটা সিনেমা চালালাম। হঠাৎ ঘরটা যেন কেঁপে উঠল। সবকিছুই কাঁপছে। ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা আগেও ছিল।
উপর তলায় থাকে আরও কয়েকজন। দুজন আই টি সেক্টরে আছে। একজন পড়াশোনা শেষ করে কোচিং কম্পিটিশন পরীক্ষার কোচিং নিচ্ছে। ওরাও লেটে ওঠা পাবলিক। দুজন বাড়িতেই ছিল।
ওরাও সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে এল। সবাই নেমে এলাম রাস্তায়। ওদের মধ্যে একজনের নাম বিশ্ব। সে সারাক্ষণ হাতে মোবাইল নিয়েই থাকে। সব সময় চোখ মোবাইল স্ক্রিনে। সারাদিন ফেসবুক আর হোয়াটস আপ ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।
সবাই তখন রাস্তায়। কেউ কেউ খালি পায়েই নেমে এসেছে। কেউই ফোন সঙ্গে নিতে পারেনি। একমাত্র বিশ্ব, সে ফোন নিয়ে বেরোতে ভোলেনি। অনেকের চোখেমুখেই তখন আতঙ্কের রেশ। বিশ্বের চোখ তখনও মোবাইল স্ক্রিনে। সে নিজেই সেলফি তুলছে। একবার পাশএর বাড়ির একজনকে বলল, ছবি তুলে দিতে। এভাবেই খান পনেরো ছবি তুলল। তারপর আপন মনে এইসব ছবি পোস্ট করা শুরু করল।
ফেসবুক কোম্পানি জানতে পারলে, এই দৃশ্যটাকেই তাদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করত। এত আপডেট দিয়ে, কাদের কাছে কী প্রমাণ করতে চাইল, কে জানে!
—–
গোটা বাংলাই কাঁপিয়ে দিল!
অনির্বাণ পাত্র
আমার উপর তলায় থাকেন, রায়বাবু। কট্টর বামপন্থী সমর্থক। কলকাতা ভোটের পর থেকেই তাঁর মন খারাপ। গত কয়েকদিন ধরেই বলছন, এটা আবার ভোট হয়েছে নাকি! সব লুট হয়েছে। জঙ্গলের রাজত্বে বাস করছি।
আজ সকাল থেকেও তার মন খারাপ। নটার সময় একবার দেখা হল। বললাম, কী বুঝছেন ? বললেন, এটা আবার ভোট হচ্ছে নাকি ? গায়ের জোরে সব দখল করতে চাইছে। একটাও ছাড়বে না। এভাবে জিতে তোরা কী করবি ? মানুষ তোদের আরও বেশি করে ঘৃণা করবে।
কথাগুলো আমার উদ্দেশ্যে নয়, তৃণমূলের উদ্দেশ্যে। বাড়িতে বসে নিশ্চয় টিভি দেখছিলেন। ভূমিকম্পের আতঙ্কে সবাই বাইরে। তিনিও বেরিয়ে এলেন পাজামা আর স্যন্ডো গেঞ্জিতেই। তখন ভূমিকম্প থেমে গেছে। রায়বাবুর মন পড়ে সেই ভোটেই। আশেপাশের বাড়ির প্রায় সবাই নেমে এসেছিল। দু’বাড়ি পরে থাকা চন্দনদার (তিনিও বাম মনস্ক) দিকে গেলেন রায়বাবু ।
আর থাকতে পারলেন না। বলেই ফেললেন, সকাল থেকে তৃণমূলিরা কী করছে দেখেছেন! গোটা বাংলাটাকেই কাঁপিয়ে দিল!