বিষণ্ণতার বিশ্বকাপ

ময়ূখ নস্কর

সেটা ছিল ১৯৮৫ সাল। আমার বয়স মোটে সাত। আর যুবভারতী স্টেডিয়ামের বয়স এক বছর।

তখনও ঘরে ঘরে টিভি ঢুকে পড়েনি। মোবাইল তো কল্পবিজ্ঞান। তখনও আমরা মারাদোনার নাম শুনিনি। তখনও
আমাদের কাছে বিশ্ব ফুটবল মানে নেহরু কাপ আর আই এফ এ শিল্ড। তখনও নেহরু কাপ আজকের মতো এলেবেলে হয়ে যায়নি। খেলতে আসত উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনার, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, পূর্ব জার্মানি, চিন, যুগোস্লাভিয়ার মতো দেশ। আর আসত সোভিয়েত। তখনও আই এফ এ শিল্ড পাড়ার টুর্নামেন্ট হয়ে যায়নি। খেলতে আসত ইরানের পাস ক্লাব। কোরিয়ার পিয়ংইয়ং। সোভিয়েতের আরারাত।

১৯৮৫-র আই এফ এ শিল্ডের ফাইনালে উঠল পেনারোল আর সাখতার। বাবা তিনটে টিকিট কেটে আনল। ফাইনালের। আমি, বাবা আর পাড়ার এক দাদা যাব। গ্রাম থেকে সবে কলকাতায় এসেছি। ফুটবল মানে জানি মোহনবাগান। পেনারোল? সাখতার? এদের নামই শুনিনি। খেলা দেখতে গেলে তো কাউকে সাপোর্ট করতে হবে। কিন্তু যাদের নামই শুনিনি তাদের মধ্যে সাপোর্ট করব কাকে? বাবা, এরা কোথাকার ক্লাব?‌

nehru cup1

বাবা বলল, পেনারোল উরুগুয়ের আর সাখতার সোভিয়েতের। ব্যস সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। বাবা, ঠাকুরদা বামপন্থী। দেওয়ালে লেনিনের ছবি। বাড়িতে সোভিয়েতের বই আসে। সেই বইতে জাদুকরী ভাসিলিসার গল্প পড়ি। ভাসিলিসা, প্রথম বান্ধবী, প্রথম প্রেমিকা, তার দেশকে ছেড়ে অন্য কাউকে সাপোর্ট করা যায়?

সেদিনের সেই ফাইনালে সাখতার জিততে পারেনি। কিন্তু সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিল সোভিয়েত দল। ৮৫, ৮৬, ৮৭, ৮৮ বছরের পর বছর তারা নেহরু কাপ জিতত। আজ মনে আছে আলেক্সি মিখায়েলচেঙ্কোর নাম। মনে পড়ে তার হাতে নেহরু কাপ। মনে পড়ে তার বুকে লেখা CCCP.

সেই CCCP-তে হচ্ছে বিশ্বকাপ। না না CCCP তো নয়, রাশিয়া। CCCP তো ভেঙে চুরমার। শুধু কি সোভিয়েত? গোটা কমিউনিস্ট ব্লক ভেঙে চুরমার। সোভিয়েত ব্লকের যত দেশ- পুসকাসের হাঙ্গেরি, স্তোইচকভের বুলগেরিয়া, হাজির রোমানিয়া, স্তোইকোভিচের যুগোস্লাভিয়া, নেদভেদের চেকোস্লোভাকিয়া – কমিউনিস্ট জমানার দুর্ধর্ষ দেশগুলির একটিও হাজির নেই লেনিনের দেশে। হাঙ্গেরি ফুটবল বিশ্বে এখন করুণার পাত্র, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া কোথায় কে জানে, পূর্ব জার্মানি কোন দেশ আর এই গ্রহের মানচিত্রে নেই। যুগোস্লাভিয়া আর চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে স্লোভাকিয়া-স্লোভেনিয়া-সার্বিয়া-বসনিয়া-হার্জেগোভিনা-ক্রোয়েশিয়া-ম্যাসিদোনিয়া কত টুকরো যে হয়েছে, আরও কত টুকরো যে হবে কে জানে!‌

আর সোভিয়েত? না থাক হাতের সামনে জেনারেল নলেজের বই না থাকলে সব কটা টুকরোর নাম বলা অসম্ভব। মিখায়েলচেঙ্কো তো এখন ইউক্রেনের নাগরিক। সাখতার এখন ইউক্রেনের ক্লাব। আর সেই ইউক্রেন রাশিয়ার শত্রু। আই এফ এ শিল্ডে মোহনবাগান যাদের রুখে দিয়েছিল, সোভিয়েতের সেই দুর্ধর্ষ আরারাত এখন আর্মেনিয়ার ছোটখাটো ক্লাব। ভাসিলিসা কোন দেশে থাকে কে জানে?

russia

জানি, খেলার সঙ্গে রাজনীতিকে মেশাতে নেই। জানি, বিশ্ব ফুটবলে সোভিয়েত বিরাট বড় কোনও শক্তি ছিল না। ফুটবলকে ভালবাসলে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, পর্তুগালকেই সমর্থন করা উচিত। আজ আমি এদের মধ্যেই একটি দেশকে সমর্থন করি।

কিন্তু যদি সব কিছু অন্য রকম হত, যদি সোভিয়েত অটুট থাকত, যদি তার পতাকা আজও থাকত টকটকে লাল, যদি সেই দেশেই হত আজকের বিশ্বকাপ? যদি সেই দেশের জার্সিতে লেখা থাকত CCCP? আমি কি পারতাম অন্য কোনও দেশকে সমর্থন করতে?

ভাসিলিসার দেশ। প্রথম প্রেমিকার দেশ। তাকে ফেলে কি অন্য কাউকে সমর্থন করা যায়?

 

(‌বেঙ্গল টাইমসও মেতে উঠেছে বিশ্বকাপে। তবে, একেবারেই অন্য আঙ্গিকে। আমাদের শৈশব–‌কৈশোরের সঙ্গে, আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে আছে বিশ্বকাপ। সেই সব মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখাই উঠে আসছে বেঙ্গল টাইমসে। হয়ত অনেক স্মৃতি, অনেক আবেগ জড়িয়ে আছে আপনার সঙ্গেও। চাইলে, মেলে ধরতে পারেন। এই বিশ্বকাপ আবহে ফিরে দেখতে পারেন ফেলে আসা সেই দিনগুলোকে।)‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.