কীভাবে সরে যেতে হয়, বুদ্ধদেববাবু জানেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না। তাই তাঁরা জোর করে পদ আঁকড়ে পড়ে থাকেন। মনে রাখবেন, বুদ্ধবাবু সরে দাঁড়ালেন তাঁর গ্রহণযোগ্যতা একটুও কমবে না। সবসময় মমতার সমালোচনা না করে দলীয় নেতারা বুদ্ধবাবুকে দেখেও তো কিছু শিখতে পারেন। লিখেছেন অমিত ভট্টাচার্য।।
দারুণ দুটি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন সর্যকান্ত মিশ্র। কমিউনিস্টসুলভ দৃঢ়তা। হ্যাঁ, এই দৃঢ়তাই দেখিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই জন্যই তাঁকে এত ভাল লাগে।
প্রথমেই বলে রাখি, আমি বামমনষ্ক হলেও নিজের বুদ্ধি–বিবেচনাতেই চলি। পার্টিলাইন মেনে কথা বলতে হবে, এমন কোনও ফতোয়া আমার ওপর কখনও চাপাইনি। নিজের যুক্তি ও চিন্তাকে বিসর্জন দিইনি। নানা ব্যাপারে বামেদের সমালোচনা করতেও আমার কোনও কুণ্ঠা নেই।। এর বড় একটি কারণ, বামপন্থীরা দেওয়ালের লিখন পড়তে পারেন না। কিছুতেই নিজের জায়গা ছাড়তে চান না। সেই জায়গায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মারাত্মক এক ব্যতিক্রম।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি কী কী করেছিলেন, করতে চেয়েছিলেন, সেসব বিষয়ে যাচ্ছিই না। আমি ২০১১–র পরবর্তী বিষয় নিয়েই বেঙ্গল টাইমসের ওপেন ফোরামে দু–চার কথা বলতে চাই। তারপর থেকে পলিটব্যুরোর কোনও সভায় তিনি যাননি। কেন্দ্রীয় কমিটির কোনও সভায় যাননি। এমনকী সেই মিটিং কলকাতায় হলেও এড়িয়ে থেকেছেন। বলা হয়েছে শারীরিক কারণ। আসলে, উনি জানেন, কখন জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। কিছু প্রতিবাদও হয়ত ছিল। হয়ত কিছু অভিমানও ছিল। কিন্তু জোর করে জায়গা আঁকড়ে থাকার মানুষ তিনি নন। নিজের অনুপস্থিতি দিয়েই নিজের প্রতিবাদ বুঝিয়ে দিয়েছেন। অহেতুক বাজার গরম করেননি, জলঘোলা করেননি।
পরাজয়ের পর থেকে কখনও তাঁকে প্রেস কনফারেন্স করতে দেখেছেন? গত তিন–চার বছরে কোনওদিন তাঁকে টিভি চ্যানেলের স্টুডিওতে দেখেছেন? এমনকী পার্টি অফিস ঢোকার সময় বা বেরোনোর সময় কখনও বাইট দিতে দেখেছেন? তাঁর ফেসবুক বা টুইটারও নেই। এসব কোনওকিছুই তাঁর লাগে না। তা সত্ত্বেও বামেদের মধ্যে এখনও সবথেকে গ্রহণযোগ্য নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ তো আগেই ছেড়েছেন। এবার রাজ্য কমিটি ও সম্পাদকমণ্ডলী থেকেও সরে দাঁড়ালেন। নানা অনুরোধ এলেও তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল। হ্যাঁ, সরতে চাইলে সরে দাঁড়ানো যায় (যদি সত্যিই সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছে থাকে)। দলের কমিটিকে রইলেন কী রইলেন না, কী যায় আসে! এখনও তিনি আগের মতোই প্রাসঙ্গিক।
কিন্তু দলের বাকি নেতাদের সম্পর্কে কি সেটা বলা যায়? তাঁরা ফেসবুকে নিজেদের জানান দিচ্ছেন। প্রেস কনফারেন্স করার সুযোগ পেলে ছাড়তে চান না। ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পেলে থামতে চান না। আর দলের পদ না পেলে কত লোকের গোঁসা হয়ে যাচ্ছে। দলের পদ পাওয়ার জন্য কতরকমের লবিবাজিই না হচ্ছে। দল ক্ষমতার ত্রিসীমানা থেকে এত দূরে। তবু পদ দখলের কী মরিয়া চেষ্টা! ছেড়ে দিলে যদি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাই!
কেন পিছিয়ে পড়ছি, কেন মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি, সেই আত্মসমীক্ষা নেই। এঁরা ভেবে নিয়েছেন মমতা ব্যানার্জির নামে ফেসবুকে কিছু জোকস ছেড়ে দিলেই হয়ত এঁরা দারুণ জনপ্রিয় হয়ে যাবেন। গুটিকয় ‘লাইক’ পেয়েই এঁদের জীবন ধন্য। না আছে পড়াশোনা, না আছে যুক্তির বিন্যাস। না আছে সামাজিক গ্রহণযোগতা। দলীয় বৃত্তের বাইরে এঁদের কোনও জগৎ আছে বলেও মনে হয় না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশার ব্যাপারে এখনও অদ্ভুত এক ছুৎমার্গ। আমি সব জানি, বাকিরা সব অর্বাচীনের দল। এরকম একটা হাবভাব। সারাক্ষণ অন্যদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার স্বভাবটা এখনও অনেকেরই যায়নি। আর এইসব লোকেরা এখনও সামনে আছেন বলেই দলটার এই দুর্দশা।
বুদ্ধবাবু কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে, রাজ্য কমিটি থেকে সরে দাঁড়াতে পারলেন। বাকিরা জেলা কমিটি, এরিয়া কমিটি থেকে সরতে পারছেন না? কী ভাবছেন, সরে গেলে কেউ পাত্তা দেবে না। এমন আশঙ্কা কেন? মানুষের সঙ্গে যদি সুসম্পর্ক থাকে, মানুষ ঠিক মনে রাখবে। মানুষ ঠিক গুরুত্ব দেবে। যদি না দেয়, তাহলে বুঝবেন, এতদিন অকারণেই গুরুত্ব পেয়েছেন। এই গুরুত্ব বোধ হয় আপনার প্রাপ্য ছিল না।
প্লিজ, মমতার সমালোচনা পরে করবেন। আগে বুদ্ধদেববাবুকে দেখে কিছু শিখুন।
(এটি ওপেন ফোরামের লেখা। ওপেন ফোরাম মানে, পাঠকের মুক্তমঞ্চ। নানা বিষয়ে আপনিও নিজের মতামত মেলে ধরতে পারেন। এই লেখাটির সঙ্গে একমত হতে পারেন। ভিন্নমতও থাকতে পারে। সুস্থ বিতর্ক উঠে আসুক বেঙ্গল টাইমসের পাতায়। )
bengaltimes.in@gmail.com