শোভন চন্দ
২৩শে এপ্রিল আজ থেকে ঠিক ৪০০ বছর আগে এই দিনটিতে এক বিদেশি সাহেব আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ।৪৫০ বছর আগের কথা ইংল্যাণ্ডের ষ্ট্র্যাটফোর্ড আপন এভনে একটি লোক এলেন, কলমের ডগায় আপন ছন্দে জীবনের ছোট ছোট সুখ –দুঃখ, হাসি-কান্না আবেগ- অনুভূতিগুলো নিয়ে কী যেন বেশ কাটা ছেঁড়া করলেন, রচনা করলেন এক জীবন দর্শন আর কী যেন দিয়ে গেলেন পৃথিবীকে যা আজও অতুলনীয়।
১৬১৬ খ্রীঃ ২৩শে এপ্রিল মৃত্যুর আগে শেক্সপিয়র খুব ভুগেছিলেন সমানে মাথা ব্যাথা ও ক্লান্তিতে। নিদ্রাহীনতা আর অস্বস্তিতে শরীরও দুর্বল হয়ে এসেছিল। তারপর একদিন অসুস্থতার মধ্যেই বিদায় নিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়র । ভাবতে অবাক লাগে এই বিস্ময়ের বিচিত্র কর্মকান্ডকে ! এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর সাইত্রিশ নাটক, একশো চুয়ান্ন সনেট এবং ছটি কবিতা গুচ্ছের কোথাও কোনওখানে বয়সের একটুও ছাপ পড়েনি ।
আজও জীবনের অর্ন্তদ্বন্দ্বে দাঁড়িয়ে জীবনের মূল্যবোধকে সন্ধান করতে, জীবনবোধকে এক অনন্য মাত্রা দান করতে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে গভীর মননশীল মানুষেরা ফিরে যান “এভনের কবি”র দুয়ারে। তার সাহিত্য চর্চা লেখনীর বৈচিত্র্য আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তবে আজ ৪০০ বছর পেরিয়ে বর্তমান সময়ে যে বিষয়টি শেক্সপিয়রকে আলাদা মাত্রা দান করেছে তা হল তাঁর সাহিত্য কর্মকে সিনেমায় অনুসরণ। সাহিত্য থেকে সেলুলয়েডে তাঁর এই যাত্রা দীর্ঘ দিনের। বহুকাল থেকেই হলিউডে তাঁর কাহিনি অনুসরণে সিনেমা তৈরি হয়েছে। দেশ কালের গন্ডি ছাড়িয়ে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখা গেছে ভারতীয় সিনেমাতেও । হিন্দি বাংলা তামিল তেলেগু নানান ভাষায় সিনেমা তৈরি হয়েছে ।
একটু গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্র, মুন্সি প্রেমচন্দ থেকে রাস্কিন বন্ড সংখ্যার দিক থেকে এদের সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছে শেক্সপিয়রের কাহিনীর অ্যাডপশন । অবশ্য এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, এত যার প্রেমিক –প্রেমিকা, খলনায়ক, এত প্রেম কখনও হ্যামলেটের দ্বন্দ্ব কখনও লেডি ম্যাকবেথের ক্রূর হিসেব নিকেশ কখনও বা আবার ওথেলোর ঈর্ষা কিংবা রোমিও জুলিয়েটের নিষিদ্ধ মিলন রহস্য –রোম্যান্স- রোমাঞ্চ এত বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনকে সিনেমায় অনুসরণ অস্বাভাবিক কিছু নয় এ তো হওয়ারই ছিল।
ভারতীয় সিনেমা তখন সবে মাত্র পথ চলা শুরু করেছে, পার্শ্বি থিয়েটার থেকে বলিউডের অভিষেক হচ্ছে, সদ্য শব্দের আগমন ঘটেছে তখনই মার্চেন্ট অব ভেনিস অবলম্বনে পরিচালক বাবুরাও পেন্টার তৈরি করলেন হিন্দি সিনেমা “সভকারি পাস “ ভালবাসা- অর্থ- আত্ম স্বার্থের গল্প তারপর “কেবি আথাভালে” হ্যামলেট অবলম্বনে তৈরি করলেন “খুন- এ – নাহাক সাত বছর পর সোহরাব মোদি তৈরি করলেন “খুন কা খুন”। তারপর একে একে জালিম সৌদাগর, দো দুনি চার, অঙ্গুর মকবুল ওমকারা হায়দার ।
ক্যায়ামত সে ক্যায়ামত তক, ইসকজাদে ,ইসাক, রামলীলা একের পর এক সিনেমা হয়েছে। বলিউডের শেক্সপিয়র প্রীতি অজানা নয়। তবে বাংলা চলচিত্রে এই সাহেবের ম্যাজিক ততটা কার্যকরী নয়। বাংলার এই ফেলুদা ব্যোমকেশের সাম্রাজ্যে ম্যাকবেথ কিংবা হ্যামলেট কোথাও যেন তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে এ কথা বলা যাবেনা যে বাংলা সিনেমায় শেক্সপিয়র পুরোপুরি ব্রাত্য। অতীতে ভ্রান্তিবিলাস বর্তমানে হৃদমাঝারে এছাড়াও অপর্ণা সেনের আরশিনগর সর্বত্রই তিনি ।
সত্যি বলতে কি শেক্সপিয়র আজ কোনও নির্দিষ্ট শ্রেণীতে বন্দী নেই। কোথাও যেন তাঁর সাধারণীকরণ ঘটেছে। কখনও কাশ্মীরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, কখনও বা গুজরাতের জাতিগত দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে নায়ক নায়িকার সুপারহিট কেমিষ্ট্রিকে কাজে লাগিয়ে আইটেম ড্যান্স ভরপুর অ্যাকশন সব মিলিয়ে দর্শকদের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। তাঁর এই জীবন বোধের অন্বেষণের যাত্রা কালক্রমে বিস্তার লাভ করবে।
৪০০ বছর ধরে এক অসাধারণ সমকালীন লেখক যিনি সাহিত্য থেকে সিনেমায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিচরণ করে চলেছেন স্বমহিমায়। সত্যি, সময় পেরিয়ে যাবে নিজের ছন্দে, তবে যতদিন সৃষ্টি থাকবে, ততদিন সমস্ত কিছুর উর্দ্ধে থেকে যাবে এই ৪৫০ বছর বয়সী সাহেবের ম্যাজিক।