ছাত্রদের আত্মহনন:‌ এক সামাজিক সমস্যা

আজকের এই বাজার সংস্কৃতিতে নিজেকে মেলে ধরার প্রবণতা যে পরিমাণ বেড়েছে তাতে আত্মপ্রচার এখন সর্বজনবিদিত, যে পিছিয়ে যাবে সে–‌ই মার খাবে। শহুরে সভ্যতার এটাই মূল শিক্ষা। আধা গ্রামীণ বা মফস্বল সভ্যতায় কোথাও যেন একটা টান আছে এখনও। তফাত আসে তাতেই। ধাক্কা খাওয়া আসে তাতেই। বিশ্লেষণ করেছেন অম্লান রায়চৌধুরী।।

এই আত্মহনন আজকাল বেশ শোনা কথা। পুরোপুরি কারণ না জানলেও বোঝা যায় একটা অবসাদ বা বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা কোথাও ঘেঁটে যাওয়ার মতন একটা পরিস্থিতি নিশ্চয় এর বড় কারণ।
কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়ার স্থান সবই সামাজিক এক পরিধিতে আবদ্ধ। সমাজ বা সমাজের বিভিন্ন অবস্থানগুলোকে বাদ দিয়ে বোধ হয় এই আলোচনা সম্পূর্ণ হবে না। আমরা আমাদের শিক্ষা জীবনে অর্থাৎ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিবেশ বা অবস্থা দেখেছি সেটা বড়ই ভয়াবহ ছিল। ছাত্রদের সংঘর্ষ, ইউনিয়নের আধিপত্য, গোদা ভাষায় সরাসরি রাজনীতির ছোঁয়া – সবই ছিল। অনেক ছাত্রই রোজ কলেজে আসতে পারত না। কারণ, এলেই তাকে মারা হবে। আমরা ওই সময়ে ত্রিমুখী লড়াই দেখেছি — কংগ্রেসের জরুরি অবস্থায় অযাচিত সুযোগ নেওয়া – বামপন্থীদের কথায় কথায় আন্দোলন, অতি বামদের মাঝে মাঝে গেরিলা আক্রমণ। বহু ছাত্রই সেই সময়ে লেখা পড়া শেষ করতে পারেনি কেবল এই অবস্থার জন্য। কিন্তু আশ্চর্য্য কোনওদিন এই আত্মহননের ঘটনা দেখিনি বা শুনিনি।

একটা বিষয় বোধ হয় এই অবস্থাতে ভাবা যায় যে, আমাদের সময় এই নানান রাজনৈতিক অস্থিরতার ফসল হিসাবে আমরা কিন্তু আমাদের চেনার চোখটাকে বেশ ধারালো করতে পেরেছি, ওই বয়সে আবেগ বশত অনেক হঠকারিতা সেই সময়কার ছাত্রসমাজ করেছে ঠিকই কিন্তু সচেতনতার পারদ সব সময়ই ছিল বেশ উঁচুতে, আর এই সচেতনতাই সেই সময়ে ছাত্রসমাজকে দিয়েছে অনেক যুক্তি, যেগুলো তারা কাজে লাগিয়েছে পরবর্তীকালে নানান জায়গায় – কাজেই নিজের জীবন সম্বন্ধে বা নিজেকে চেনার ব্যপারে বেশ সচল ছিল তখনকার ছাত্র সমাজ। এটা একটা উপরি পাওনা, যেটা আজ উপলব্ধি করতে পারি আর সেই জন্যই অবসাদ বা দৃষ্টিকটূ বা মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারগুলো বেশ সহজভাবেই চলে আসত। কখনই নিজেকে একা মনে হত না, কারণ বোঝাবুঝির মাত্রাটা হয়ে উঠেছে নানা ঘাত–‌প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। ছিল এক চলমান জীবন, কখনও উপভোগ্য বা কখনও কিছু আঘাতের প্রস্তুতি – এক ঘেয়ে লাগার জায়গাটাই ছিল না।

আজকের ছাত্ররা যে সমাজের প্রতিভূ সেখানে সামাজিকতায় আত্মিক টান নেই, আছে শুধু মেকি কিছু ভাবনার আদান প্রদান। তখনকার যে সমাজে আমরা বেড়ে উঠেছি – সেখানে ঘনাদা, বিল্টুদার মতন মানুষকে দেখেছি। রোজ মদ খেয়ে রাত্রি বেলায় ফিরলেও, পাড়ার কোনও মেয়েকে অন্য কেউ কিছু বললে ছেড়ে কথা বলত না, বাড়ি পৌঁছে দিত। এগুলো আমাদের শিখিয়েছে সামাজিকতার শিকড়ের বহন ক্ষমতা। আজকালকার ছাত্ররা সেই সমাজ দেখেনি – দেখেছে সবাই বাস করে এক নির্জন দ্বীপে, মাইক্রো পরিবার, কথা বলার বা শোনার কোনও লোক নেই। সবাই চায় সবাইকে পরিসর দিতে। ফলে দূরত্ব এতটাই বাড়ে যে শুধু নামটুকুই মনে থাকে, চেনা হয় না।
এর ফলে গ্রাম গঞ্জ থেকে ছেলে মেয়েরা যখন প্রকৃত ছাত্র হয়ে কলকাতা বা শহরতলির কোনও কলেজে আসে – এক বিশাল ফারাক দেখতে পায়। চলনে, বলনে, সংস্কৃতিতে, আচারে, বিচারে। মানাতে বেশ কষ্ট, মেনে নেওয়াটাও বেশ কঠিন। এই দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে না আসতে পারাটাই আত্মহননের ইচ্ছার জন্ম দেয়। এটাকে আমি ভীরু মানসিকতা বলব না, বলব এত ফারাক কাটিয়ে ওঠার ব্যর্থতা।

student5

চিরকালই কিছু ছাত্র থাকে বেশ চুপচাপ, উচ্ছাস কম, কিন্তু বোধ শক্তি খুব প্রবল। তারা সবকিছুকেই গ্রহণ করে কিন্তু মর্মান্তরে পৌঁছানোর ব্যাপারে বেশ সুক্ষ নির্বাচন করে, যাতে যেটা ঢোকে সেটা ঢোকাবার পরিকল্পনা যেন আগে থেকেই করা হয়ে থাকে। এদেরকে আজও দেখা যায় আমাদের সময়ও দেখা যেত। এদের উপর চাপ কম, কাজেই এদের দিয়ে বিচার করা সম্ভব নয় – এদেরকে তাই উহ্য রাখলাম। এ ছাড়া যারা আসে – সেই আধা শহর থেকে অথবা গ্রাম থেকে –কলেজ জীবন, নতুন জীবন, খোলা মেলা পরিবেশের হাতছানি –সবই উপভোগ্য , আকর্ষণ – সব কিছুতেই একটা বেশ রমরমা ভাব, বেশ ভালো লাগা আছে। এদের ক্ষেত্রেই কতটা মানার বা কতটা না মানার বুঝে ওঠা বেশ মুশকিল। এরা অনেকটাই চায় – নিজের ইচ্ছায়, কিন্তু কতটা পরিবেশ দেবে বা নিজের দেখে আসা, বেড়ে ওঠার জায়গার প্রভাব – সবই কেমন যেন আছড়ে পরে – ফলে এরা হয় সব চাইতে দ্বিধাগ্রস্ত — লাফ দিয়েও লাফাতে পারে না। এদের নিয়েই সব চাইতে সমস্যা। যে কোনও আঘাতই এদেরকে ভেঙে ফেলতে পারে, সামলাতে পারে না। আসলে এদের বোঝার চোখটা তৈরি হয়েছে অন্য এক আবহাওয়ায়, এসে পড়েছে অন্য এক অবস্থানে, চাওয়া আছে, ভালো লাগা আছে, কিন্তু গ্রহনীয় কতটা সেটাই ঠিক করতে পারে না। অবসাদে এরাই সবচেয়ে বেশি ভোগে। অধিকাংশ গ্রাম বা আধা শহরের ছেলে মেয়েরা এই অবস্থায় এসে পড়ে। কেউ কেউ উতরে যায় সাবলীলভাবে। কেউ কেউ পারে না, অবসাদ গ্রস্ত হয়ে পড়ে।

অথচ মেলা মেশার যে পরিবেশ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আছে এখন সেখানে এই ধরনের অবসাদ বা আত্মহননের ইচ্ছা জাগার কোনও কারন নেই। এখনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা রকমের সমস্যা চলছে, কিন্তু ছাত্র সমাজটা এখনও ভেঙে যায়নি। নতুন সৃষ্টিতে এখনও তারা বিশ্বাসী। যে ছাত্র সমাজ কে আমরা চিনেছি তারা কিন্তু এখনও আছে।

হ্যাঁ, তফাতটা এসেছে। মূলত শিক্ষা ব্যবস্থার খোলাখুলি পরিসরে, ফলে অনেক ছাত্রই আসে এমন একটা মানসিকতা নিয়ে, যেখানে তারা অনেক কিছুই দেখেনি, খোলামেলা মেলামেশায় অস্বস্তি, আচরনে সংঘাত, ব্যবহারে ভীতি – এই সমস্তই বাধা সৃষ্টি করে। চেনা হয়ে ওঠে না কলেজ জীবনের সাবলীলতা।

এখনও শহুরে প্রগতির রুপরেখা গ্রামীণ বা আধা শহরগুলিতে সমপরিমাণ প্রভাব বিস্তার করেনি, কারন পল্লী বা গ্রাম বা আধা শহরের যে কৃষ্টি আমরা দেখেছি সেটা এখনও আছে। ফলে লজ্জার সংজ্ঞা পাল্টানো, ভালো খারাপের ব্যবধান সংকুচিত হওয়া, কোনওটাই ওদের জানা হয়নি, কাজেই বেশ প্রভাব ফেলে।

মানছি, বিশ্বায়নের ফলে গ্রাম ও সেই গ্রাম নেই বা মফস্বলও সেই মফস্বল আর নেই। বাজারিকরণের প্রভাবে অনেক ঝকমকে আবহ তৈরি হয়েছে। শপিং মল হয়েছে সেই সুদূর গ্রামেও, কিন্তু মানসিকতার পরিবর্তনটা এখনও হয়নি, যেটা সময়সাপেক্ষ। কাজেই সেখানের দেখার সঙ্গে শহুরে দেখা মেলে না। যুক্তির দুর্বলতা বা সংস্কারের প্রাধান্য প্রায়শই এই ব্যবস্থাটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। ফলে যে ছাত্রটি সুদূর গ্রাম থেকে কলকাতায় পড়তে আসে, বেশ হীনমণ্যতায় ভোগে–এটা দেখা গেছে আগেও এবং এখনও। এই হীনমণ্যতাটা পুরোটাই সৃষ্ট। যারা পারে এই রোগের থেকে বেরিয়ে আসতে তারাই মিলতে পারে, মেলাতে পারে। যারা পারে না তারাই একাকীত্ব অনুভব করে, অবসাদে ভোগে।
এটা ঠিক কৃষ্টি বা সংস্কৃতির ফারাকে বেশ কিছু অবজ্ঞা বা পাত্তা না পাওয়ার অবস্থা প্রায়শই গড়ে ওঠে প্রথমের দিকে । এর পরিচয় বেশ পাওয়া যায়। কিন্তু কাটিয়ে ওঠার মানসিকতাও দেখা যায় বহুলাংশে । এটা ব্যাক্তি নির্ভর একটা অবস্থা । সেইই ঠিক করবে কেমন ভাবে উতরানো যায় । বহু গ্রামের ছেলে কলেজের শেষ জীবনে এমন ভাবে নিজেকে গড়েছে যে সেই গ্রামেরই অন্য ছেলে তাকে দেখলে চিনতে পারবেনা – এটা তার ক্ষমতা । আমি বলতে চাইনা যে সে তার শিকড় থেকে বেড়িয়ে গেছে , শুধু নিজেকে যুগোপযোগী করেছে মাত্র , এটাই তো মানিয়ে নেওয়া ,– এটাই ওকে জায়গা দেবে ভবিষ্যতের পাঠশালায় ।

student4

এছাড়া আছে আর এক সমস্যা । মেধার প্রকাশের অক্ষমতা । বাচন ভঙ্গীতে তফাত, প্রকাশে অস্পষ্টতা, সে সম মেধা সপন্ন দুটি ছাত্রের মধ্যে অন্তর শুধু কে কেমন ভাবে নিজেকে মেধার সাপেক্ষে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ক্লাসের লেকচারের সময় , একটি গ্রামের ক্ষুরধার মেধা সম্পন্ন ছেলে যে ভাবে নিজেকে ক্লাসের মধ্যে প্রমাণ করতে পারে সে ভাবে শহুরে পরিবেশে সম মেধাসম্পন্ন ছেলেটির উপস্থাপনা একেবারেই আলাদা, অনেক দৃষ্টি নন্দন, অনেক গ্রহণযোগ্যতা আদায় করে নেয় – এটা একটা সমস্যা , সেই গ্রামের ছেলেটির কাছে – হীনমন্যতার জন্ম – উতরাবার উপায় নেই। অনেকে এটাকে বলে স্মার্টনেস, কেউ কেউ বলে পরিবেশ নির্ভরতার প্রকাশ। কিন্তু সকলের কাছে এটার পার্থক্য ধরা পড়ে। কিছুদিন আগে কাগজেই পড়া প্রেসিডেন্সি কলেজের এক ছাত্রীর আবেদন যে ক্লাসে লেকচারের সময় বাংলার ব্যবহার বাড়ানো উচিত , না হলে তার পক্ষে সব বিষয় ভালোভাবে বুঝে ওঠা সম্ভব নয় – মেয়েটি কিন্তু মেধাসম্পন্ন মেয়ে এবং ভালো নম্বর নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এটা পার্থক্য সৃষ্টি করে । এই পার্থক্য ক্লাসের মধ্যে সবাই নজর করে – একটা আবরণ তৈরি হয়, যেটাই ভবিষ্যতে ছাত্রটিকে হীনমন্যতায় ভোগায় – সে ভাবে আমিও তো জানি , তবে কেন ওভাবে শিক্ষকের সামনে বলতে পারলাম না?‌ এটা আমারই অক্ষমতা – মেলানো বড়ই কঠিন। কেউ কেউ পারে এর থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে মেনে নেয় – অভাবটাকে শক্তিতে পরিণত করে অন্য ভাবে। বেঁচে যায়। জীবন সুন্দর ভাবে চলে । কোনও ভাবেই একাকীত্ব আসে না – কলেজ জীবনটা উপভোগ্য হয় ।

student3

কলেজ জীবন, মোহ , ভালো লাগা ভালোবাসার আঁতুড় ঘর। সবারই জানা। এখানে ‘টাইম পাস’ বলে একটা কথা এখন বেশ প্রচলিত – যেখানে কেউ কারুর সঙ্গে ভালো লাগাকে বেসাতি করে কিছুটা সময় বা কাল কাটায় – বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েই। কোনও কমিটমেন্ট থাকে না, কোনও ভবিষ্যত থাকে না, জল্পনা বা কল্পনার জন্ম হয় না। কিছুটা সময় কেটে যায় এইভাবেই। উভয়েই প্রস্তুত থাকে এর ফলাফলে। পুরোনো ধ্যান ধারনায় বশবর্তী হয়ে যেই কেউ এইরকম সম্পর্কে জড়িয়ে পরে – অনেক কিছু ভেবে ফেলে, ভবিষ্যতের ডাল পালা কে মান্যতা দিতে আরম্ভ করে। তখনই আসে নৈরাশ্য। কিছুদিন বাদে যখন এটা জানা যায় বা বোঝা যায়। এই শ্রেণীর অধিকাংশই গ্রাম বা আধা মফস্বল শহরের থেকে আসা ছাত্র ছাত্রীরা। যারা এখনও প্রেম ভালবাসাটাকে বা ভালো লাগাটাকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দেয় ও জীবন পঞ্জীর সঙ্গে এক করে নিতে চায় । ধাক্কা আসে। নৈরাশ্য আসে, কারণ ফলাফল সবারই জানা।

আজকের এই বাজার সংস্কৃতিতে নিজেকে মেলে ধরার প্রবণতা যে পরিমাণ বেড়েছে তাতে আত্মপ্রচার এখন সর্বজনবিদিত, যে পিছিয়ে যাবে সে–‌ই মার খাবে। শহুরে সভ্যতার এটাই মূল শিক্ষা। আধা গ্রামীণ বা মফস্বল সভ্যতায় কোথাও যেন একটা টান আছে এখনও। তফাত আসে তাতেই। ধাক্কা খাওয়া আসে তাতেই। মেধা বা মনন সমতা সেভাবে প্রভাব ফেলে না যে ভাবে হওয়া উচিত। কাজেই আসে বিষন্নতা, উদাসীনতা এবং সব শেষে আসে নৈরাশ্য। যেটা দেখা যায় আজকাল। তাই এত আত্মহননের খবর। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। এটা কাম্য নয় জেনেও বলতে হয় এর থেকে পরিত্রাণের উপায়ও জানা নেই। যদি না ছাত্ররা নিজে থেকে বিষয়টাকে উপলব্ধি করে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.