সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
হে বঙ্গ, আজ তুমি ধরা দিলে, এ কোন রূপে
চোখ মেলে চেয়ে সভয়ে দেখি, রয়েছি বারুদের স্তূপে !!
হ্যাঁ, এটাই বাংলার বাস্তবচিত্র এখন। যে বাংলা স্বাধীনোত্তর ভারতে বছরের পর বছর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে এসেছে, বাবরি মসজিদ ভাঙার পর সারা ভারতে যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আগুন জ্বলে উঠেছিল, তার এতটুকু আঁচও যে বাংলার গায়ে লাগেনি, বা তারও আগে ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পরে কংগ্রেসীদের দ্বারা সারা ভারতবর্ষে যখন শিখ নিধন যজ্ঞ চলেছিল, তখনও যে বাংলা সযত্নে প্রায় দশ হাজার শিখ ধর্মাবলম্বীকে আশ্রয় দিয়েছিল, তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পেরেছিল, সে বাংলাই আজ ধূলাগড়, কালিয়াচক বা বাদুরিয়া-বসিরহাটে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়া ও তার থেকে ভয়াবহ দাঙ্গার সাক্ষী হয়েছিল। আর সেই ভয়াবহতার তালিকায় আরও দুটি জায়গার নাম যুক্ত হল আসানসোল এবং রানীগঞ্জ।
আসলে এটা হওয়ারই ছিল। এই অবস্থা তখনই তৈরি হয়,যখন সাধারণ মানুষের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান না করে, তাদের চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা না করে, পথে- ঘাটে মহিলাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে কোনও নির্বাচিত সরকার সেই মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে। যা বর্তমানে বাংলার তৃণমূল সরকার সাঙ্ঘাতিকভাবে করে চলেছে। অনেকসময় সেই বিভাজনটা স্পষ্ট না হলেও, বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত না হলেও কোনও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি সীমাহীন তোষণ থেকেও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মনেও সেই তুষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতি ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভটাই একসময় দাঙ্গার আকার নেয়। বাংলায় বর্তমান সরকারের মুখ্যমন্ত্রী যেমন মুসলিম বা সংখ্যালঘুদের প্রতি একটু বেশিমাত্রায় “উদার”। তিনি নিজে তথাকথিত ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে হয়েও ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে মুসলিমদের পরব মানে ঈদের সময় হিজাব বা বোরখা পরেন, এমনকি মুসলিম মহল্লাতে গিয়ে বা মসজিদে গিয়ে তাকে নামাজ পড়তেও দেখা যায়। তিনি মুসলিমদের জন্য ইমাম ভাতা চালু করেছেন। দিনের পর দিন তিনি মুসলিমদের তোল্লা দিয়ে তাদের নিজের বশীভূত করে ফেলেছেন। স্বভাবতই তার শাসনাধীনে বাংলায় সংখ্যালঘু বা মুসলিমদের একটা অংশের মধ্যে “বেপরোয়া” একটা মানসিকতা এমনভাবে তৈরি হয়ে গেছে যে, তারা হিন্দুদের উৎসব পালনেও আজকাল হুমকি দিচ্ছে বা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কোথাও দুর্গাপুজো করতে বাধা দিচ্ছে, কোথাও রাতের অন্ধকারে দুর্গা বা কালীমূর্তির মাথা ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে, কোথাও বা স্কুলে স্কুলে সরস্বতী পুজো পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে তো মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষপাতদুষ্ট মানসিকতা আছেই। তিনি বিজয়া দশমীর দিন মুসলিমদের কোনও অনুষ্ঠান থাকলে-(যেমন ঈদ বা মহরম) অবিলম্বেই সেইদিন মুসলিমদের অনুষ্ঠানের কথা মাথায় রেখে দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেন। তিনি বীরভূমের মণিরুল ইসলামকে আজ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করার মত সাহস দেখাতে পারলেন না, যিনি প্রকাশ্য সভায় নিজের মুখে খুন করার কথা স্বীকার করেছিলেন এবং কংগ্রেসের এক নেতাকে খুনের হুমকি দিয়েছিলেন। একইভাবে ভাঙড়ের দাপুটে নেতা আরাবুল ইসলামও আজ বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। গার্ডেনরিচের একটা স্কুলে নির্বাচনের সময় এক দুস্কৃতীর গুলিতে মারা যান ইন্সপেক্টর তাপস চৌধুরী—যাকে খুনের ঘটনায় তৃণমূল কাউন্সিলর ইকবাল-(মুন্না) এর নাম জড়িয়েছিল। কিন্তু সেই সংখ্যালঘু নেতাটিরও কি আদৌ কোনও বিচার হল? সেকারণেই ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে সংখ্যালঘু নেতা ত্বহা সিদ্দিকি একথা বলার মত সাহস পেয়েছিলেন যে,“বাংলায় কারা সরকার গড়বে তার নির্ণায়ক হব আমরা”। অথচ একথা বলার মত ঔদ্ধত্য কোনও সংখ্যালঘু নেতার আদৌ ছিল বামেদের সময়ে ? একটা মুসলিম নেতারও সাহস হয়েছিল দুর্গাপুজোয় বাধা সৃষ্টি করার বা স্কুলে সরস্বতী পুজো করা যাবে না—এই ফতোয়া জারি করার ? বাম শাসনের মুখ্যমন্ত্রীরা কোনও বছরেই মুসলমানদের পরবের কথা মাথায় রেখে দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের দিনক্ষণ বদলে দেননি। বরং প্রশাসনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে হিন্দু ও মুসলিম—উভয় সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানই সুচারু রুপে সম্পন্ন করেছিলেন। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো ভয়াবহ ঘটনার পরেও বাংলার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তার প্রশাসন কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “বাংলায় কেউ দাঙ্গা লাগাতে এলেই গুলি চালাবে, সে যে কোনও সম্প্রদায়েরই হোক। আর তার ফলও হয়েছিল আশানুরূপ। বাংলায় তার আঁচটুকুও সেভাবে লাগেনি।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর সেই সাহস বা সদিচ্ছা আদৌ আছে ? থাকলে তিনি ধূলাগড় বা বসিরহাটের দাঙ্গার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে “রামনবমী” কে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তা রোধ করতে সচেষ্ট হতেন। তা তিনি তো করলেনই না, উপরন্তু বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলো “রামনবমী” পালনে উদ্যোগী দেখে তিনিও তাদের সঙ্গে “হিন্দুত্বের” প্রতিযোগিতায় নিজের দলকে নামিয়ে দিলেন। আর সেই ভয়ানক প্রতিযোগিতার পরিণাম হল আসানসোল ও রানীগঞ্জের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা যা দাঙ্গার আকার নিল। আর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তখন নিজের রাজ্যে থেকে তার পুলিশ প্রশাসনকে সেই দাঙ্গা রোধের জন্য সঠিকভাবে কাজে না লাগিয়ে দিল্লিতে গিয়ে উপস্থিত আগামী লোকসভা ভোটের জোটসঙ্গী খুঁজতে।
আর এর বিপরীতের মেরুকরণের চিত্রটাও ভয়ঙ্কর রূপে প্রতিভাত। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে বিপুল সংখ্যক আসনে জিতে দিল্লির মসনদ দখল করার পরে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির সীমাহীন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সারা ভারতেই কম বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। কোথাও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে, কোথাও সংখ্যালঘু শ্রমিককে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, বা কোথাও ঈদ উপলক্ষ্যে ঘরে ফেরার সময় ট্রেনের মধ্যেই জুনেইদকে পিটিয়ে মারা হল। দেশের নানা জায়গায় সংখ্যালঘুদের হয় বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে অথবা টাকার বিনিময়ে “হিন্দু” তে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে মুসলিমদের খাদ্যাভ্যাস ও অন্যান্য আচার-আচরণে বিধি নিষেধ আরোপের চেষ্টা। শুধু মুসলিমরা নয়, খ্রীষ্টানদের ওপরেও অনেক জায়গাতেই আঘাত নেমে আসছে। স্বভাবতই এই “উগ্র হিন্দুত্ববাদ” এর বিরুদ্ধে যেখানে যেখানে মুসলিমরা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ,সেখানেই তারাও নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে আক্রমণ শানাচ্ছে, যা দাঙ্গা সৃষ্টি করার পক্ষে যথেষ্ট। অথচ ২০০২ সালে গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গার পরে সেই দাঙ্গায় স্বজন হারানো এবং করজোড়ে প্রাণভিক্ষা করা কুতুবুদ্দিন আনসারিকে বাংলায় আশ্রয় দিয়ে সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই সময়ে কারও আদৌ ক্ষমতা ছিল বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার? অথচ আজ মেরুকরণের রাজনীতির ফলেই একদা সেই সম্প্রীতির মিলনতীর্থ বাংলাতেও দাঙ্গা লাগছে একের পর এক আর এই দুটো দল তবুও ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক সংহতি নষ্ট করে চলেছে।
মেরুকরণের এই ঘৃণ্য রাজনীতি বাংলাকে অচিরেই গুজরাট বা উত্তরপ্রদেশে পরিণত করবে না তো?