উন্নয়ন থেকে অনেক দূরে। ‘নেই’এর তালিকাটা বেশ লম্বা। তবু অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে ওরা নিজেদের মতো করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। উজানের টানে তাদের সঙ্গে কয়েকটা দিন। সেই অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিই ভাগ করে নিলেন সংহিতা বারুই।।
উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে এখনও অনেকটাই দূরে। বসন্তে কোথাও কোথাও পলাশ ফুলে আছে ঠিকই। একটু দূরে আস্ত একটা পাহাড় উকি মারছে ঠিকই। তবু তীব্র দাহদাহে যেন ধূসর প্রকৃতি।
শুধু সবুজ পাহাড় নয়। অনেক সমস্যাও যে পাহাড়ের চেহারা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। রাস্তা থেকে পানীয় জল, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, যেদিকেই তাকাবেন, বিস্তর সমস্যা। তার মধ্যেও ওরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। তার মধ্যেও ওঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
এর আগেও বেশ কয়েকবার অযোধ্যা পাহাড় ও সংলগ্ন এলাকায় গেছি। কখনও নিখাদ বেড়াতে, কখনও ট্রেকিংয়ে। যেতে যেতেই কেমন যেন ভাল লেগে যাওয়া। মনে হয়েছে, শুধুই কি বেড়াবো আর ফিরে যাবো? আর কি কোনও দায়িত্ব নেই? এই ছোট ছোট ছেলেগুলোর পাশে আমরা কি দাঁড়াতে পারি না? না, ওদের জীবন বদলে দেওয়ার মতো সামর্থ্য হয়ত আমাদের নেই। কিন্তু ওদের লড়াইয়ে তো কিছুটা হলেও সামিল হতে পারি।
আমাদের একটি ছোট্ট সংগঠন আছে— উজানের টানে। কোনও এনজিও নয়, কোনও কর্পোরেট সংস্থাও নয়, কোনও রাজনৈতিক দলের দাক্ষিণ্যপুষ্টও নয়। একেবারে নিজেদের ছোট ছোট যোগাযোগ ও উদ্যোগ নিয়ে মানুষের পাশে থাকা। নানা পরিচিত মানুষেদর কাছে পুরানো জামাকাপড়, বইখাতা সংগ্রহ করি। ছোট ছোট ছেলেদের মাঝে তা বিলিয়ে দিই।
এখন আর সেভাবে চাইতেও হয় না। যাঁরা জানেন, তাঁরা নিজেরাই যোগাযোগ করেন। জামাকাপড়, বইপত্র দিয়ে যান। কারণ, যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরা অন্তত এটুকু জানেন যে প্রতিটি জিনিস ঠিকঠাক লোকের হাতে পৌঁছচ্ছে। এবার আমাদের অভিযান ছিল অযোধ্যা সংলগ্ন এলাকায়। স্থানীয় কিছু সহৃদয় মানুষের সাহায্যে বেছে নিলাম তিনটি জায়গা। মাঠা, বাঘমুন্ডি গার্লস স্কুল, আর তালাডি। আমার সঙ্গে ছিল সিদ্ধার্থ দাস, দিগন্ত সরকার ও পার্থ। দিগন্ত শুধুমাত্র এই অভিযানে সামিল হতে ছুটে এসেছিল মালদা থেকে। এত জামাকাপড় আর বই নিয়ে যাব কীভাবে ? ত্রিবেণী থেকে সিদ্ধার্থদা তার গাড়ি নিয়ে হাজির। আমাদের সঙ্গে ছিল দু হাজারের বেশি পুরনো জামাকাপড় আর অসংখ্য বই। অনেকদিন ধরেই এগুলো সংগ্রহ করেছিলাম। চেনা–জানা অনেককেই বলে রেখেছিলাম, কিছু বই দিতে। অনেকের বাড়িতেই নানারকম শিক্ষামূলক বই ছিল। যেগুলি হয়ত তাঁদের পড়া হয়ে গেছে। আর কখনই হয়ত পড়া হত না। অথবা, বাবা পড়তেন, কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর ছেলে–মেয়েদের তেমন আগ্রহ নেই। তারা হয়ত পাতা উল্টেও দেখে না। একটা সংশয় ছিল, কী জানি, লোকে বইপত্র দেবে তো? পরে দেখা গেল, যা প্রত্যাশা ছিল, তার থেকে অনেক বেশিই জোগাড় হয়েছে। সব বইগুলো হয়ত ওদের কাজে লাগবে না। তবু কাজে লাগার বইও যে অনেক ছিল। সঙ্গে কেউ কেউ নতুন খাতাও কিনে দিয়েছেন। অনেকে সঙ্গে যেতে পারেননি। কিন্তু বই বা জামাকাপড় দিয়ে পাশে থেকেছেন। এঁদের সবাইকে নিয়েই ‘উজানের টানে’র বৃহত্তর পরিবার। কী করে ভুলব সেখানে গিয়ে সনাতন সিংহবাবু, দীপক রজক বা সুপ্রিয় দাসের কথা! সারাক্ষণ তাঁরা যেভাবে পাশে থেকেছেন, কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।
কত অভাব, অভিযোগ আর সমস্যার মিছিল। সরকারি স্কুলগুলোয় স্কুল সময়মতো বই–খাতা পৌঁছয় না। কখনও শুনছি, এক বাবা নাকি তিন মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছেন। কত ছেলেমেয়ের পড়াশোনা মাঝপথেই থেমে গেছে। কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া তো আছেই। তবে পাশাপাশি রেখা কালিন্দীর মতো লড়াকু মেয়েরাও তো আছে, যার অদম্য জেদ বিয়ে রুখে দিয়েছিল। মাঠায় ছৌ শিল্পীদের মাঝেও কাটল অনেকটা সময়। কত অজানা দিক উঠে এল। কী করে ভুলব বাঘমুন্ডির সেই ছোট ছোট মেয়েদের অনুষ্ঠান! এমন প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করেও নিজেদের এমনভাবে মেলে ধরা সম্ভব! শহরের তথাকথিত বড় বড় স্কুলগুলোকে অনেক পেছনে ফেলে দিতে পারে। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, একটু তালিম পেলে এরা কোথায় পৌঁছতে পারে!
আমাদের সামর্থ্য সত্যিই সীমিত। কতটুকুই বা করতে পারি! একটা যন্ত্রণা যেন তাড়া করে বেড়ায়। তবে পাশাপাশি নিজেদের চেনা জগত ছেড়ে ওই বাচ্চাদের ভিড়ে, ওই সহজ সরল মানুষগুলোর ভিড়ে হারিয়ে যেতে ভালই লাগে। একটা দিনের জন্যও তো ওদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। তার একটা তৃপ্তিও আছে। মনে হল, এখানেই থামা নয়। আরও অনেককিছুই করার আছে। আবার ফিরে যেতে হবে, ওই ছোট ছোট মেয়েগুলোর পাশে। এই অঙ্গীকার নিয়েই ফিরে আসা। উজানের টানে আবার ঠিক ভেসে যাব।