যাত্রা, তোমার যাত্রা শুভ হোক

সংহিতা বারুই

‌যাত্রার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কতটুকু?‌ রথযাত্রা বা মহালয়ার দিনে কাগজে ঢাউস ঢাউস বিজ্ঞাপন বেরোয়। কোনওটা হাফ পেজ। কোনওটা কোয়ার্টার পেজ। বিচিত্র সব নাম। তাই দেখে আমাদের শহুরে মনে নানা হাসি ও বিদ্রুপের উদ্রেক হয়। ঠুনকো শহুরে আভিজাত্য নিয়ে আমরা নাক সেঁটকাই। ছি:‌ এগুলো আবার দেখে নাকি!‌
কিন্তু সেই ভুলটা ভেঙে গেল পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে। যাত্রাকে ঘিরে গ্রামের সহজ সরল মানুষের উন্মাদনা নিজের চোখেই দেখে এলাম। নিজেদের খুব ছোট মনে হল। এই যাত্রাকে নিয়ে, তার নামকরণ নিয়ে আমরা কত কটাক্ষই না করেছি। কিন্তু তার সঙ্গে এত এত মানুষের আবেগ ও ভালবাসা জড়িয়ে আছে, শহর বা শহরতলিতে বসে তা বোঝাই যায় না।

jatra1
আমরা গিয়েছিলাম অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন এলাকায়। সম্পূর্ণ অন্য একটা কাজে। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের যাত্রা দেখার তেমন পরিকল্পনাও ছিল না। কিন্তু সকাল থেকেই মাইকিং। দুপুর থেকেই পিলপিল করে লোক আসতে শুরু করল। শীত বিদায় নিয়েছে। রোদের চোখরাঙানিও শুরু হয়েছে। দুপুর দিকে লু বইতেও শুরু করেছে। তার মাঝে এত লোক!‌ ট্রাকে করে এসেই চলেছে!‌ এরা সব কারা?‌ কোথা থেকে এসেছে?‌ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। বুঝলাম, দূরদূরান্ত থেকে শুধু যাত্রার টানেই তারা ছুটে এসেছে। জমিন ৫০, চেয়ার ১০০। অনেকে আগে থেকেই টিকিট কেটে রেখেছিলেন। বাকিরা এখানে এসে আগে টিকিট কেটে নিলেন। কাউন্টারের সামনেও বেশ লম্বা লাইন।
বিকেল গড়াতে না গড়াতেই অযোধ্যার মোড় যেন জনসমুদ্র। বোঝাই যাচ্ছিল, এক উৎসবের চেহারা নিতে চলেছে এই যাত্রা। যাত্রাপালার নাম:‌ কুরুক্ষেত্রে কাঁদছে কৃষ্ণসখী দ্রৌপদী। স্বপন সাউয়ের এই পালা হবে পাঁচটি স্টেজে। একসঙ্গে পাঁচটি মঞ্চে যাত্রা!‌ এমনটা শুনেছি বটে, কিন্তু কখনও চোখে দেখা হয়নি। একটু একটু করে ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠল। সঙ্গে যাওয়া দিগন্ত, সিদ্ধার্থ ও পার্থও এক কথায় রাজি। আমরাও ঢুকে পড়লাম সেই যাত্রার আসরে।

jatra2
হাজার হাজার মানুষ। পিলপিল করছে। বাজনা বেজে উঠতেই সে কী উন্মাদনা!‌ সংলাপগুলো খুব যে মন ছুঁয়ে যাওয়া, এমন নয়। হয়ত মেলোড্রামা মনে হতেই পারে। কিন্তু সন্ধে থেকে সিরিয়াল নামক যে বস্তুটি আমরা গোগ্রাসে গিলি, তাতেও কি মেলোড্রামা নেই? সিরিয়ালের সঙ্গে যাত্রার তফাত এই, সিরিয়াল ঘরের ড্রয়িংরুমে বসেই দেখা যায়। পরিশ্রম করতে হয় না। কিন্তু এই যাত্রা দেখতে এত দূরদূরান্ত থেকে ট্রাক, ম্যাটাডোর ভাড়া করে আসতে হয়। তাও আবার ভরদুপুরে। ভালবাসা কতটা গভীর হলে এভাবে দুপুর থেকে আসা সম্ভব!‌
এই উন্মাদনা সত্যিই আমাদের অজানা ছিল। নতুন এক জানালা যেন খুলে দিয়ে গেল অযোধ্যা। অথচ, এই শিল্পমাধ্যম সম্পর্কে আমরা কত উদাসীন!‌ ফিরে এসে বলতে ইচ্ছে করছে, যাত্রা, তোমার যাত্রা শুভ হোক।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.