লোকদেখানো ধমক নয়, পুলিশকে কাজ করতে দিন

কুশমন্ডির ঘটনার পর মঞ্চ থেকে ধমক দেওয়া হল পুলিশ অফিসারদের। কিন্তু নারী নির্যাতন ঠেকাতে সরকার কি সত্যিই আন্তরিক?‌ অতীত ইতিহাস কিন্তি তা বলছে না?‌ ধর্ষণ হলেই প্রথম কাজ অস্বীকার করা, পরের কাজ বিরোধীদের নিশানায় তোলা। তারপর রেট বেঁধে দেওয়া। এই মানসিকতা নিয়ে যদি সরকার চলে, তাহলে তো নির্যাতন বাড়বেই। লিখেছেন সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি।।

 

সেদিন টিভি চ্যানেলে দেখলাম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কুশমণ্ডির ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি–‌কে নাকি তুলোধনা করছেন, কেন ওই ধর্ষিতা হতভাগিনী মেয়েটির বিবস্ত্রা দেহ দীর্ঘসময় মাঠের ধারে পড়ে ছিল এবং প্রশাসনের নজর পড়েনি, ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং নিজের স্বভাব অনুযায়ী তিনি ধর্ষিতা মেয়েটিকে ইতিমধ্যেই ৪ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণাও করে দিয়েছেন।

কিন্তু মাননীয়া, শুধু “আইনের রক্ষকদের” এরকম প্রকাশ্যে ধমকি-চমকি দিয়ে কি আর ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যধি যা আপনার শাসনকালে বাংলায় মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছে দার্জিলিং থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগণা, তাকে কোনওদিন রুখতে পারবেন? এ তো শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত ব্যর্থ প্রয়াস! এই ব্যধিকে নির্মূল করার জন্য দরকার নিজের মানসিকতার পরিবর্তন। পুলিশ প্রশাসনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে সঠিক তদন্ত করানোর সদিচ্ছা থাকাও দরকার। তা আপনার আদৌ রয়েছে তো?

rape2
পার্ক স্ট্রিটে সুজেটের ধর্ষণের পরে আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল ? “সাজানো ঘটনা” বলে বিরোধীপক্ষকে আক্রমণ করতে আপনার রুচিতে বাধেনি সেদিন। আর আপনার দলের, আপনার মন্ত্রীসভার মন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়া? যত কম বলা যায় ততই মনে হয় ভালো। তদানীন্তন “পরিবহনন্ত্রী” র উক্তি ছিল, “ওই মেয়েটি অত রাতে ওখানে কি করছিল?” আর আপনার দলের এক মহিলা সাংসদের সাফাই ছিল, সেটা নাকি সেই হতভাগ্য মেয়েটি আর তার খদ্দের এর মধ্যে বিবাদের কারণে ঘটেছে! অথচ পরে দময়ন্তী সেনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছিল। জানা গিয়েছিল যে মোটেই “সাজানো ঘটনা” নয়। সত্যিই মেয়েটি ধর্ষিতা হয়েছিল। যদিও সেই ধর্ষিতা আজ আর বেঁচে নেই, তবুও সে কিন্তু সুবিচার পায়নি। মূল অভিযুক্ত আজও অধরা আর সেই “নির্ভীক” পুলিশ অফিসারের “পুরস্কার” ছিল অন্যত্র বদলি!! ভাবুন একবার। ১১ কোটি বঙ্গবাসীর মুখ্যমন্ত্রী আর তার সরকারের এই রুচিবোধ, এই মূল্যবোধ?

শুধু পার্ক স্ট্রিট কান্ড নয়, এরকম উদাহরণ অজস্র আছে। কামদুনির মতো মর্মান্তিক ঘটনার পরে যখন আপনি নানা চাপে প্রায় ১০দিন পরে অকুস্থলে গিয়ে হাজির হলেন তখন সঙ্গত কারণেই আপনাকে ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দারের ক্ষোভ ছিল। সেখানে গিয়েই আপনি বুঝলেন হাওয়া অনুকূল নয়, তাই সেই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে দুজন প্রতিবাদী মহিলাকে “মাওবাদী” তকমা দিয়ে বাংলার জনসাধারণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার পন্থা নিলেন। আর তার ফলে সেই দুটি প্রতিবাদী মহিলার ওপর আপনার দলের স্থানীয় নেতাদের রোষানল বেড়েই চলল। তাদের নিরাপত্তারও ব্যবস্থা আপনি করেননি বা করতে চাননি। অথচ আপনিই রাজ্যের একাধারে প্রশাসনিক প্রধান এবং পুলিশমন্ত্রী। সর্বোপরি নিজে একজন মহিলা !

এরপরে গাইঘাটা, তারপরে গেদে, তারপরে কাটোয়া—একের পর এক ধর্ষণ আর নারী নির্যাতন। কখনও আপনার “প্রতিক্রিয়া” ধর্ষিতার স্বামী সিপিএম করে, তো কখনও আপনি মানতে চান না ধর্ষণ হয়েছে। রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। আর ফলস্বরূপ সারা দেশের মধ্যে বাংলা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনে শীর্ষ স্থান অধিকার করল। অথচ বঙ্গবাসীর করের টাকায় গোটা বাংলার “গলি থেকে রাজপথ” এ অসংখ্য হোর্ডিং,ব্যানার,ফেস্টুন লাগাচ্ছেন—“এগিয়ে বাংলা”, “উন্নয়ন”,”কন্যাশ্রী” ইত্যাদি ইত্যাদি ! এই উন্নয়নের নমুনা? অথচ আপনি বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে মহাকরণে এক মহিলাকে “ধর্ষিতা” সাজিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে ইতিহাস কিন্তু বাঙালি বয়োজ্যেষ্ঠদের স্মৃতিতে আজও অম্লান।

আপনার দলের এক সাংসদ প্রকাশ্য সভায় সিপিএম কর্মীদের বাড়িতে ছেলে ঢুকিয়ে নারীদের ধর্ষণ করার হুমকি দিয়েছিলেন। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির এ হেন আচরণে আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিলো? যখন ভিডিও টি প্রকাশ্যে আসার পরে বাংলা তো বটেই এমনকি গোটা দেশ জুড়ে প্রবল শোরগোল পড়ে গেল,আপনি তবুও সেই “হীনচেতা” ব্যক্তিটির পাশে দাঁড়ালেন। একবার বললেন,“ ও ভুল করে বলে ফেলেছে” , তো পরেই আবার অন্যত্র বললেন, “এজন্য, আমি কি ওকে প্রহার করবো?” এমনকি সেই ব্যক্তিকে এই ঘৃণ্য মন্তব্যের জন্য পুলিশ প্রশাসন দিয়ে গ্রেপ্তার করানোর মত মানসিকতাও আপনার হয়নি !! তাকে দিয়ে সাধারণ একটা সাফাই গোছের “লোক দেখানো ক্ষমা” চাইয়ে নিজের ও দলের পাপমুক্ত করে দিলেন অনায়াসেই। আর সেই “বিকৃতরুচির” লোকটি সাধারণ মানুষের মতই সমাজে থেকে গিয়েছিল। এই আপনার রুচিবোধ, এই আপনার মনুষ্যত্ব ? এ তো প্রকারান্তরে সকল ধর্ষকদের কাছে এই বার্তা দেওয়া, “সরকার তোমাদের পাশে আছে”!!

মাননীয়া, ধর্ষণের মত সামাজিক ব্যধিকে সমূলে উৎপাটন করার সদিচ্ছা থাকলে পুলিশ প্রশাসনকে স্বাধীনভাবে তদন্ত করার নির্দেশ দিন। দলীয় রঙ না দেখে ধর্ষক এবং ধর্ষণকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সকলকেই গ্রেপ্তার করে আদালতে কঠোর শাস্তির মামলা রুজু করতে পুলিশ প্রশাসনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করুন। তবেই এই রোগের প্রতিকার মিলবে। আজ আপনি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে শুনলেই হয় তাকে অস্বীকার করছেন, নয়তো “বিরোধীদের চক্রান্ত” বলে চালিয়ে দিচ্ছেন বা কোথাও কোথাও ধর্ষিতার রেট বেঁধে দেওয়ার মত নিম্ন মানসিকতার কাজ করে বা তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে সেই হতভাগিনী ও তার পরিবারের মুখ বন্ধ করতে চাইছেন। কুশমণ্ডির ঘটনায় পুলিশ অফিসারদের ভৎসর্না করে দেখালেন, “আপনি নিজে কত দায়িত্বশীল”, কিন্তু তাতে কি আর সেই হতভাগিনীরা সুবিচার পাবে ? আর সমাজের এই জ্বলন্ত সমস্যার কোনও স্থায়ী সমাধান বেরোবে?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.