(একবছর আগে, ঠিক এই দিনেই চলে গিয়েছিলেন বনশ্রী সেনগুপ্ত। সেদিন তাঁকে নিয়ে একটি স্মৃতিচারণধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়েছিল বেঙ্গল টাইমসে। এক বছর পর সেই লেখা আবার ফিরে এল। পড়ুন একটি অনুষ্ঠানের মর্মস্পর্শী বর্ণনা। )
মানস মিশ্র
অনেকদিন আগের কথা। তা, বছর পনেরো তো হবেই। ময়দানেই একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। শুনলাম, বনশ্রী সেনগুপ্ত গান গাইবেন। আমি তখন মফস্বল থেকে সবে কলকাতায় এসেছি। তখন এঁরাই আমার কাছে সেলিব্রিটি। রেডিওতে যাঁর গান শুনেছি, সেই বনশ্রী সেনগুপ্ত! মনে হল, একটু থেকেই যাই।
একটু পরেই ঘোষণা শুনলাম, লোপমুদ্রাও নাকি গাইবেন। এ তো ডাবল পাওনা। একই দিনে বনশ্রী আর লোপামুদ্রা! মনে মনে বেশ রোমাঞ্চিতই হলাম। মনে হল, না হয় ফিরতে একটু দেরিই হবে। কিন্তু আজ দুজনের গান শুনেই যাব। শুরুতে উঠলেন বনশ্রী। সঞ্চালক পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেদিন কোন গানটা দিয়ে শুরু করেছিলেন, আজ আর মনে নেই। তারপরই আবদার উঠল, আজ বিকেলের ডাকে ...। বনশ্রী কিছুটা খুশিও হলেন, আবার কিছুটা হতাশও হলে। বললেন, আপনারা এই গানটা খুব ভালবাসেন, আমি জানি। কিন্তু আমি আরও অনেক গানই তো গেয়েছি। এমন দু একটা গান শোনাই। তারপর না হয় আজ বিকেলের ডাকে শোনাবো।
অন্য একটা গান ধরলেন। সেই গানটা শেষ হওয়ার আগেই বেরসিকের মতো সঞ্চালক বলে উঠলেন, ‘আমাদের পরবর্তী শিল্পী, যাঁর জন্য আপনারা অপেক্ষা করছেন, সেই লোপামুদ্রা মিত্র এসে গেছেন। এবার তিনি গান গাইবেন।’ এই ঘোষণাটা সত্যিই খুব আঘাত করেছিল। লোপামুদ্রাকে স্বাগত জানানো হোক, কিন্তু বনশ্রীর মতো একজন শিল্পীকে এভাবে অপমান করা কি খুব দরকার ছিল? তাঁর জন্য বরাদ্দ মাত্র দুটো গান! লোপামুদ্রা না এলে হয়ত আরও দু–একটা গান গাওয়ার সুযোগ হত। কিন্তু লোপামুদ্রা এসে গেছেন বলে এভাবে বনশ্রী সেনগুপ্তকে থামিয়ে দিতে হবে?
সেদিন আঘাত পেয়েছিলেন বনশ্রীও। গলা ধরে এল। বললেন, ‘ভেবেছিলাম আরও কয়েকটা গান শোনাব। কিন্তু শুনলেন তো, পরের শিল্পী এসে গেছেন। লোপা কিন্তু খুব ভাল গায়। আপনারা ওর গান শুনুন। আর উদ্যোক্তাদের বলব, লোপাকে কিন্তু দুটো গানের পর থামিয়ে দেবেন না।’ কেঁদেই ফেললেন। তারপর বললেন, গানকে ভালবাসি তো। তাই গান শোনানোর সুযোগ পেলে লোভ সামলাতে পারি না। টাকা পয়সা পাই বা না পাই, গান শোনাতে পারলেই আনন্দ পাই। কত জায়গায় তো বিনা পারিশ্রমিকে গাইতে যাই। আপনারা যদি আপনাদের পাড়ায় অনুষ্ঠান করেন, আমাকে ডাকবেন। যা সামর্থ্য তাই দেবেন। না দিলেও কিছু মনে করব না। কিন্তু একটাই অনুরোধ, মাঝপথে এভাবে নামিয়ে দেবেন না।
সেদিন বনশ্রী সেনগুপ্তর সঙ্গে আমরা অনেকেই হয়ত কেঁদে ফেলেছিলাম। তারপর কী হল, আর শুনতে ইচ্ছে হয়নি। মনে হল, আর থাকা উচিত নয়। আজ হঠাৎ শুনলাম, বনশ্রী সেনগুপ্ত নেই। মনে পড়ে গেল পনেরো বছর আগের সেই দুপুরের কথা। জানি না, আরও কত জায়গায় তাঁকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। একজন শিল্পীর মনে কত যন্ত্রণা। আমরা তার কতটুকুই বা খোঁজ রাখি!