গল্প:‌ রূপশ্রী

নন্দন ভট্টাচার্য

পল্টু ছেলেটা বেশ করিৎকর্মা। সে সব আগাম বুঝতে পারে। ছেলেটা কেন যেন লেখাপড়া শিখল না!‌ আর শিখেই বা কী করত!‌ চাকরির জন্য এর পেছনে, ওর পেছনে ঘুরে বেড়াতে হত। সাত–‌আট লাখ টাকা সেলামি দিয়ে ঢুকত একটা বারো–‌চোদ্দ হাজারের কাজে। ও বলে, চাকরি বোকা লোকেরা করে। ও বোকা নয়। ও জানে, কখন কোন অফার চলছে। সেই মতো ফোনের নম্বর বদলে নেয়। কখনও নম্বর এক রাখে, কোম্পানি বদলে নেয়। কখনও দল বদলে নেয়, কখন্ও কাগজে কলমে বউ বদলে নেয়। প্রকল্প বদলে নেয়।
কোথায় কী সরকারি স্কিম, ওর মুখস্থ। ও জানে, ক্লাবের অনুদান কী করে আদায় করতে হয়। এ তল্লাটে অনেক পুরনো ক্লাব সর্বমঙ্গলা ক্লাব। ফুটবল হত, ক্রিকেট হত, যাত্রা হত। আরও কতকিছু হত। এখনও টুকটাক কিছু না কিছু হয়। ও মা, সেই ক্লাব অনুদান পেল না। পেয়ে গেল পল্টুর ক্লাব। সেই ক্লাবের কী নাম, কেউ জানে না। সেই ক্লাব কী করে, তাও কেউ জানে না। কে সেক্রেটারি, কে ক্যাশিয়ার, তাও কেউ জানে না। শুধু পল্টু জানে। আর জানে, কাকে ধরতে হয়। কোথায় কী কাগজ জমা দিতে হয়। কোন কাগজ কীভাবে বানাতে হয়। ফল কী হল!‌ সর্বমঙ্গলা পেল না, পেল পল্টুর উড়নচণ্ডী।

rupasree2
কন্যাশ্রী থেকে যুবশ্রী, আমার বাড়ি থেকে কৃষি লোন। সবকিছুর হদিশ রাখে পল্টু। আর আমার গিন্নি আমাকে বলে, পল্টুকে দেখেও তো কিছু শিখতে পারো। দেখেছো, ওর কেমন তিন তলা বাড়ি। দুটো গাড়ি, ব্লকে ভাড়া খাটছে। সেই পল্টুই সেদিন এসে মোক্ষম একটা বুদ্ধি দিল। নামে–‌বেনামে আরও কোথায় কী আছে, কে জানে!‌ আর তুমি?‌ তোমার কোনও মুরোদ নেই। তোমার দ্বারা জীবনে কিচ্ছু হবে না।
আমি সত্যিই মাঝে মাঝে হতাশায় ভুগি। ভাবি, পল্টুর কাছে কিছু বুদ্ধি যদি ধার পেতাম!‌ পল্টু নানা সময়ে নানা বুদ্ধি দেয়নি, এমন নয়। কিন্তু আমারই দোষ। আমিই নিতে পারিনি। তাই আমি সেই নকড়ি পরামাণিকই থেকে গেছি। এবার পল্টুর কথা শুনতেই হবে। তাছাড়া, পল্টুর কথা শুনে তো ঠকিনি। আমার মেয়ে, উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে ফেল করেছিল। পল্টু ওর কাকিমাকে (‌মানে, আমার গিন্নিকে)‌ বুঝিয়েছিল, মেয়ের জন্য কীভাবে সাইকেল পাওয়া যায়। কাকে বলল, কোথায় বয়স কমিয়ে নাম লেখাল, কে জানে!‌ মেয়ের জন্য সাইকেল চলে এল। আমি বলেছিলাম, এটা কী করে সম্ভব?‌ ও সাইকেল পেল কীভাবে? যদি লোকে জানতে চায়?‌ যদি পুলিস ধরে?‌‌ পল্টু বলেছিল, ওসব তোমার ভাবার দরকার নেই। তুমি ফল খাবে, কোন গাছে ধরল, সেসব জেনে তোমার কী হবে?‌ এই সাইকেল কারা টেন্ডার পেল, কত দামে কিনল, জানো!‌ তাহলে?‌ তুমি–‌আমি তো সাইকেল পেয়েই ধন্য। কিন্তু আসল ধন্য তারা, যারা এর বরাত পাচ্ছে। আসল ধন্য তারা যারা বরাত দিয়ে কাটমানি খাচ্ছে। সেখানে আমরা চুনোপুঁটি।
কথাগুলো পল্টু মিথ্যে বলেনি। এবার বাজেট থেকেও নাকি দারুণ একটা মতলব বের করেছে। ও শুনেছে এবার নাকি মেয়েদের বিয়ের সময় রূপশ্রী দেওয়া হবে। কাগজে পড়েছে কিনা জানি না। সন্ধেবেলায় বাড়িতে হাজির। নতুন মতলব নিয়ে। এতে নাকি হাজার পঁচিশ পাওয়া যাবে। কিন্তু আমি বললাম, মেয়ের তো সবে আঠারো হয়েছে। এবার নিশ্চয় পাস করবে। কলেজে যাক, অন্তত বি এ পাসটা করুক। এখনই কেন বিয়ে দেব?‌

rupasree
পল্টু কিছুটা রেগেই গেল, এখানেই তো তোমরা ভুল করো। সময়ের কাজটা সময়ে করতে হয়। নইলে পস্তাতে হয়। ওকে আর পড়িয়ে কী করবে শুনি। ও তো আর প্রফেসর হবে না। সেই বিয়ে দিতেই হবে। তাহলে দেরি কেন?‌ পরে এই পঁচিশ হাজারের স্কিমটা নাও থাকতে পারে। পঞ্চায়েতের আগে ভালয় ভালয় করে নিতে পারলে ভাল। নইলে, যদি পাল্টে যায়, তখন নানা হ্যাপা। অন্য কেউ যদি বন্ধ করে দেয়। বা শুরুতেই হয়ত এত লোক নিয়ে নিল, পরে আর পেলেই না, তখন?‌ তার থেকে সময় থাকতে থাকতে নিয়ে নাও। কুড়ি তোমার, পাঁচ আমার। কীভাবে কী জোগাড় করতে হবে, সেসব আমার ওপর ছেড়ে দাও।
সারা রাত ভাবলাম। পাড়ায় কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনাও করলাম। শুনলাম, পল্টু নাকি আরও কয়েকজনকে এমন প্ল্যান দিয়েছে। রফা সেই কুড়ি আর পাঁচ। কেউ কেউ নাকি পাত্র দেখতে শুরুও করে দিয়েছে। পরে হলেও খরচা তো আছেই। এখন যদি কুড়ি হাজারও পাওয়া যায়, মন্দ কী?‌ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, মেয়ে বিদেয় করতে পারলেই হল। ঠাকুর যদি মুখ তুলে চায়!‌ গিন্নিকে বললাম। সেও দেখি বিয়ে দিতে চায়। বলল, পল্টু পাঁচ নেয় নিক, কুড়ি তো পাব। মাছের খরচটা তো উঠে যাবে। সত্যিই তো পরে পাবে, তার কী গ্যারান্টি আছে?‌ তার থেকে এই সময় ছেলে দেখতে শুরু করো। ছমাসের মধ্যে লাগিয়ে দাও।
বুঝলাম, পল্টু ওর কাকিমাকে বুঝিয়ে ফেলেছে। কী জানি, হয়ত আমাকেও বুঝিয়ে ফেলেছে। এমন কত পল্টু আছে। আমার মতো এমন কত বাবা আছে। তারা কী ভাবছে, কে জানে!‌ অমিত মিত্র জানে!‌ মুখ্যমন্ত্রী জানে!‌

book-banner-strip

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.