যে জমির লড়াই কলকাতায় পৌঁছয় না

সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম অতীত। জমির লড়াইয়ের ব্যাটনটা এখন ইসলামপুরের হাতে। সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে কার্যত একাই লড়ে যাচ্ছেন এক তরুণ বিধায়ক। ঠাণ্ডা ঘরের হিসেবি বিবৃতি নয়, সোশাল মিডিয়ার বিপ্লবও নয়। আসল লড়াইটা বোধ হয় অন্য ময়দানেই হয়। সেই ময়দানটাই চিনিয়ে দিচ্ছেন ভিক্টর। লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।

সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামের জমির লড়াইয়ের কথা কে না জানে!‌ ইদানীং ভাঙড় নিয়েও রাজ্য রাজনীতি উত্তাল। কিন্তু নিঃশব্দে চলছে আরও এক জমি বাঁচানোর লড়াই। কলকাতা বা দক্ষিণবঙ্গ তার খোঁজ রাখে না।

এখানে কোনও বেচারাম মান্না বা মাস্টারমশাই নেই। শুভেন্দু অধিকারী বা আবু সুফিয়ানও নেই। এই লড়াই লড়ে চলেছেন এক লড়াকু তরুণ। তাঁর নাম আলি ইমরান (‌ভিক্টর)‌। এই বাংলায় সবথেকে জনপ্রিয় যুবনেতা কে?‌ বয়সের ঊর্ধ্বসীমা যদি ৪০ ধরা হয়!‌ এখনই বলা যাক, তাঁর নাম ভিক্টর।
শুভেন্দু চল্লিশোর্ধ্ব। তাই তাঁকে ধরছি না। অনেকে নিশ্চয় অভিষেক ব্যানার্জির কথাই বলবেন। শুভ্রাংশু রায় বা সৌমিক হোসেনদের নামও কারও কারও মনে পড়তেই পারে। কোনও সন্দেহ নেই, অভিষেক যথেষ্ট প্রভাবশালী। রাজ্যের মন্ত্রী, সাংসদরাও তাঁর কাছে হাতজোড় করে কার্যত নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ডিএম, এসপিরা জানেন, ক্ষমতার ভরকেন্দ্র কোনদিকে, কাকে তোয়াজ করতে হবে। জেড ক্যাটাগরির গ্ল্যামার তো আছেই। কিন্তু পিসির আনুকূল্য ছাড়া তিনি কতটুকু, ঘোর সন্দেহ আছে। তাঁর যেটুকু প্রভাব, তার অন্তত ৯৫ শতাংশ পিসির সুবাদেই। এমন যুবককে আর যাই হোক, জনপ্রিয় বলা যায় না। আর শুভ্রাংশু বা সৌমিক!‌ ক্ষমা করবেন, কোনও দিক থেকেই ভিক্টরের একশো মাইলের মধ্যেও এই দুজনকে আনা যায় না।

victor3

জনপ্রিয়তার কথা থাক। এই মুহূর্তে ইসলামপুরে যে জমি আন্দোলন চলছে, তার খবর কে কতটুকু রাখেন?‌ কলকাতার কাগজগুলিতেই বা কতটুকু বেরিয়েছে?‌ যে সরকার কৃষকদের বন্ধু বলে নিজেদের জাহির করে, ঘটা করে জমি ফিরিয়ে দেয়, সেই সরকারের নগ্নরূপটাকে ভিক্টরই রোজ তাঁর লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরছেন। বিধানসভার ভেতর তাঁর লড়াই ইতিমধ্যেই বেশ ছাপ ফেলেছে। বাইরের লড়াইটাও আরও বর্ণময়। ইসলামপুর তাঁর নির্বাচনী এলাকা নয়। তা সত্ত্বেও এই এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন এই সুদর্শন যুবক। মন্ত্রী, আমলা থেকে শুরু করে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কপালে চিন্তার ভাঁজ।

তিরিশ বছর আগের বাজারদরে জমি নিতে চাইছে সরকার। সেই জমি জোর করে অধিগ্রহণের জন্য তাবড় তাবড় মন্ত্রী থেকে এলাকার নেতা, ডিএম–‌ এসপি থেকে পাচার সিন্ডিকেট কার্যত সর্বশক্তি নামাতে হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত নীতি, অনিচ্ছুকদের জমি জোর করে নেওয়া হবে না। অথচ, এই অঙ্গিকার যেন মুখ থুবড়ে পড়ছে ইসলামপুরে। সেখানে জমি দখলের জন্য নগ্নরূপটা বেআব্রু হয়ে গেছে। গৌতম দেব থেকে শুভেন্দু অধিকারী, মন্ত্রীরা কার্যত মস্তানের ভাষায় হুমকি দিয়ে চলেছেন। সেগুলো কাগজে ছাপাও হচ্ছে। কিন্তু ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একটি যুবক— ভিক্টর।
তাঁর সাফ কথা, আমরাও উন্নয়নের বিরোধী নই। বাইপাস হোক, সবাই চাই। চাষিরাও জমি দিতে রাজি। কিন্তু আশির দশকের বাজার দরে নয়। তাঁদের কোনও অবাস্তব দাবি নেই। চাকরির দাবিও নেই। তাঁরা শুধু চাইছেন, এই সময়ের বাজার দরে যেন জমি নেওয়া হয়। খুব অনায্য দাবি?‌ সিঙ্গুরে মমতার দাবি তো এর থেকে বহুগুন বেশি ছিল। সরকার বা শাসক দল ভেবে নিয়েছিল, সবাই সুট সুট করে জমি দিয়ে দেবে। কোনও বাধাই আসবে না। কিন্তু ভয় দেখাতে গিয়েই বিপত্তি। ভিক্টরের নেতৃত্বে আন্দোলন এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে, পিছিয়ে আসা ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনও রাস্তা খোলা নেই। সরকার পিছিয়ে যাবে!‌ তা কী করে হয়!‌ ভোট ছাড়া একের পর এক পুরসভা, কলেজ সব দখল হয়ে যাচ্ছে, বিরোধীরা জিতলেও দল ভাঙিয়ে হাতে পতাকা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন যাদের দাপট, এত যাদের ‘‌অনুপ্রেরণা’‌, তারা পিছু হটবে?‌ এ কেমন কথা?‌

victor4

চাষিরা সড়কের ওপর ট্রাক্টর তুলে দিলেন। চাষ শুরু করে দিলেন। ব্যাটারা বড্ড বেড়েছে। এবার তো কিছু একটা করতেই হয়। অতএব, ভিক্টরকে জেলে পোরো। সেটাই করল প্রশাসন। কিন্তু একজন বিধায়ককে এভাবে গ্রেপ্তার করলেও মুশকিল। সারা রাজ্যে ছড়িয়ে যাবে। জো–‌হুজুর মিডিয়াকে না হয় কব্জা করা আছে। কিন্তু সোশাল মিডিয়ায় যদি ভাইরাল হয়ে যায়!‌ অতএব, ছেড়ে দেওয়া হল। রাতে জেলাশাসক বললেন, বিধায়ককে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এসডিও ঘোষণা করলেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ডিএম বললেন হয়নি। এমন কতকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

না, কলকাতার মূলস্রোত মিডিয়ায় এসব আন্দোলনের কথা নেই। থাকবেও না। জেলার রিপোর্টার পাঠালেও কলকাতার ডেস্ক তাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলবে। তাই বলে লড়াই কি থেমে থাকবে?‌ এতরকম টোপ দিয়েও ভিক্টরকে যখন কেনা যায়নি, এবারও যাবে না। সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও কীভাবে লড়াই করতে হয় চাকুলিয়ার এই তরুণ বিধায়ক দেখিয়ে যাচ্ছেন। এই লড়াই সবার কাছেই শিক্ষণীয়। ঠাণ্ডা ঘরের বিবৃতি নয়, সোশাল মিডিয়ার বিপ্লবও নয়। আসল লড়াইটা বোধ হয় অন্য ময়দানেই হয়। সেই ময়দানটাই চিনিয়ে দিচ্ছেন ভিক্টর।

কলকাতার আকাশ দিদিমণির হোর্ডিংয়ে ঢেকে থাকুক। উৎসবের বন্যা বয়ে যাক। মিডিয়া যত খুশি মুখ ঘুরিয়ে থাক। লিখে রাখুন, এই আন্দোলন দাবানল হয়ে উঠবে। জমির আন্দোলন কতটা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাবে শাসকদল। যার কিছুটা শুরু ভাঙড়ে। ব্যাটনটা এখন ইসলামপুরের হাতে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.