দার্জিলিং ম্যানিয়াক (প্রথমপর্ব)

সন্দীপ লায়েক

‌কয়েকমাস আগেও অশান্ত দার্জিলিং, চৌপাট প্ল্যান, প্রায় ক্যান্সেল বুকিং। এখন একটু একটু ঠাণ্ডা পড়ছে। পর্যটকের ভীড়ও বাড়ছে। তার মধ্যেই অবাধ্য মন থেকে উথলে ওঠা অগোছালো কিছু কথা..অবশ্যই দার্জিলিং ঘিরে।
অঞ্জন দত্ত। বেশ উদ্ধত। দারুণ কথা বলেন। ছন্দমিলিয়ে গান লেখেন। কিছু গান দুর্দান্ত বেশ কিছু উপভোগ্য। অসম্ভব ভাল অভিনেতা, খুব ভাল পরিচালক। কিন্তু এসবের বাইরে তার অন্য একটা পরিচয় আছে–তিনি আমারই মত দার্জিলিংপ্রেমী। সিনেমা, টেলিফিল্ম, গান সবেতেই দার্জিলিং।

darjeeling3
তাই এই শেষের পরিচয়টাই আমাকে সবচেয়ে ভাল লাগে। মন খারাপ হলেই দেখে ফেলি তাঁর টেলিফিল্ম ‘দার্জিলিং-দার্জিলিং’, ‘পলাতক’, সিনেমা ‘চলো-লেটস গো’, গেয়ে উঠি তার সেই অবিস্মরণীয় গান—খাদের ধারের রেলিংটা, সেই দুষ্টু দোদো শিরিংটা, আমার শৈশবের দার্জিলিংটা।
নাহ, তাঁর মত শৈশবটা আমার দার্জিলিংএ কাটেনি ঠিকই কিন্তু শৈশব থেকেই মনের ভীতর দার্জিলিং চুপ মেরে বসেছিল প্রায় 30টা বছর।
এযেন দূর হতে কাউকে না দেখে স্রেফ মনে মনে ছবি এঁকে প্রেমে পড়ে যাওয়া। প্রতিবছর গরম পড়লেই বাবা বলতো ‘জানিস, দার্জিলিংয়ে গেলে এখনও সোয়েটার পরতে হবে।’ ছোট্ট আমি হাঁদার মত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে পড়ে যেতাম, এমন জায়গা নাকি সত্যিই এই রাজ্যই আছে? গরমে কুলকুল করে ঘামতে ঘামতে ভাবতাম বড় হলে ওখানে একটা বাড়ি বানাবই বানাব, এখানে ফিরব শুধু শীত পড়লে।
নাহ, বাঙ্গালীর দীঘা-পুরী-দার্জিলিং এর দীপুদা টা বাবা দেখাতে পারেননি, দীপুতেই আটকে গিয়েছিলেন। হতে পারে আমার জন্যই হয়ত ফেলে রেখে গিয়েছিলেন।
বয়স বাড়লে যখন 2013 র মার্চ শেষে যখন প্রথম তার সাক্ষাত পেলাম তখনও ট্রয়ট্রেন দার্জিলিং থেকে কার্সিয়াংয়ে শেষ, ভানুভবনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রথম দিনটা বেশ ঠান্ডা লেগেছিল। কিন্তু পরদিন থেকে? ঠান্ডার আদর অ্যাডজাস্ট করে-আপাদমস্তক দার্জিলিংইয়ান।

darjeeling4
নিউ জলপাইগুড়িতে শেয়ার গাড়ির আবদার মিটিয়ে, তিস্তাকে দূরে রেখে, পাকদন্ডি পথ বেয়ে, গরম থেকে ক্রমশ হিমেল আবেশ পেতে পেতে, পথের পাশে পাশে বাঁধানো ঢিপি, সারি সারি সবুজ বেঞ্চ, সরু রডের ওপর পতাকার মত মার্ক করা বাড়ি হোটেল বা পথের নাম, দুঃখ তাড়ানিয়া চ্যাপ্টা নাক ঠোঁট মুখ দেখতে দেখতে পৌঁছে গিয়েছিলাম কল্পনার দেশে।
ম্যালের পিছনে একটা হোটেলে উঠেছিলাম, রুম থেকেই দেখা যেত শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। হোটেলটি ছিল ম্যাল ছড়িয়ে ভানুভবনের পাশদিয়ে রাজভবনকে বামদিকে রেখে একটা বাঁকের পরে। ম্যালে হেঁটে আসার পথটা ছিল বড়ই মনোরম, হাল্কা কুয়াশায় ঢাকা, একদিকে পাহাড় অন্যদিকে খাদ।
ম্যালটা গ্যাংটকের মত গুছানো নয় ঠিকই কিন্তু প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে, কচিবুড়োর মন ভরিয়ে আভিজাত্যর এক চূড়ান্ত নিদর্শন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় স্রেফ সেখানে দাঁড়িয়ে, ঠিক যেন সদ্য প্রেমে পড়া মানুষটি চোখের সামনে মৌন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চারপাশে মহিলারা উনুনে ভুট্টো সেঁকছেন, কাছেই স্টেটব্যাংক ATM, পাশের নিচু রাস্তার ফুটপাথ জুড়ে শাল-সোয়েটার-টুপি, অল্প-দূরে ঝুপড়ির মত দোকানে লিটটি-মোমো-চা, ঘোড়ায় চেপে বাচ্চারা, খোশমেজাজে বয়স্ক-বয়স্কা, সদ্যবিবাহিত দম্পতি, হুল্লোড়ে মেতে ব্ন্ধুবান্ধব..ফিরতে কার মন চায়? আমার তো নয়ই…।
শহুরে ব্যস্ততা থেকে অল্প মুক্তি পেলেই মনে হয় আমি যেন একদণ্ড শান্তির চাদর পরে আজও ওখানেই।

(‌অপেক্ষা করুন পরের কিস্তির জন্য)‌

(‌দার্জিলিংকে ঘিরে নস্টালজিয়া। এমনই নস্টালজিয়া আপনার ভেতরেও থাকতে পারে। জায়গাটা দার্জিলিংও হতে পারে। অন্য কিছুও হতে পারে। মেলে ধরুন আপনার অভিজ্ঞতা। পৌঁছে যাক বেঙ্গল টাইমসের হাজার হাজার ভ্রমণ পিপাসু পাঠকের কাছে। সঙ্গে ছবিও পাঠাতে পারেন। লেখা ও ছবি পাঠানোর ঠিকানা— bengaltimes.in@gmail.com)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.