পাশে থাকা ঠিক কাকে বলে? হাতে হাত ধরে হাঁটা নাকি ফেসবুকে চ্যাট করে যাওয়া! আসলে মানেটা অবশেষে বোঝা গেল। লিখেছেন কুণাল দাশগুপ্ত।।
সম্পাদক মশাইয়ের বেলটা ঝড়াং ঝড়াং করে বাজলেই আমার বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করে ওঠে। এদিনও তাই হল। দুরুদুরু বুকে ঘরে ঢুকে তাকাতেই মনে হল, শোলের গব্বর সিং যেন চিবিয়ে খাবে আমাকে। মিনমিনে গলায় বললাম, স্যার কিছু বলবেন?
নিচু স্বরে বললেন, সে কারণেই তো বেল বাজালাম। বলছি, কাজ না করে তো দিব্যি মাইনে গুনছ। তা, দু–চারটে ছবিও তো আঁকতে পারো।
স্যার, পর পর অসুখের অন্তাক্ষরি চলছিল আমার। টাইফয়েড, ডেঙ্গু–। আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করতেই সম্পাদক থামিয়ে দিলেন। বললেন, তোমার ডেঙ্গুর জন্য আমার কাগজ তো পঙ্গুত্ব লাভ করছে।
বললাম, স্যার, একটু পাশে থাকুন। শরীরটা যে কিশোর কুমারের চলতি কা নাম গাড়ির মতো লড়ঝড়ে হয়ে গেছে।
ও হে, গোত্র গুপ্ত, আমি পাশে আছি বলেই সংসারে তোমার স্ত্রী, পুত্র, কন্যারা তোমার পাশে আছে। নয়তো, চাকরি নট হলে লালকার্ড দেখিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিত। পাশে থাকা কাকে বলে, এই বয়সেও শিখলে না?
বিরক্তির সঙ্গেই বললেন সম্পাদক মশাই। পাশে থাকার ছবিও ফরমাশ করলেন।
হাজির করলাম পাশে থাকার ছবি। লেকের ধার দিয়ে তরুণ–তরুণী হাত ধরাধরি করে হাটছে। ক্যাপশন দিলাম, একইসাথে হাত ধরে একই পথে চলব। দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বস।
রেগে মেগে বললেন, এই যে বললাম, আমি তোমার পাশে আছি। তার মানে কি হাত ধরে বসে আছি? মুর্খ, পাশে থাকার মানে কাছাকাছি, ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকা নয়। দূরে থেকেও পাশে থাকা যায়। মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলাম। আধঘণ্টার মধ্যে ছবি নিয়ে এলাম। স্যার হতবম্ব হয়ে বললেন, এর অর্থ কী? বললাম, দেখছেন তো মোবাইলে দুটো ছেলে আর মেয়ে কথা বলছে। ছেলেটা বিদেশে থাকে, প্রেমিকার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলছে। ক্যাপশানটা তাই লিখলাম— মেরা পিয়া গ্যায়ে রঙ্গুন/কিয়া উঁহাসে টেলিফোন।
ছবিটা নিয়ে দলামচড়া করে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। বিধ্বস্থ মন নিয়ে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম, পাশে থাকার অর্থ কাকে বলে। আসলে, পিতৃদেবের আকস্মিক প্রয়াণের পর চারপাশটা ফাঁকাই ছিল। পাশে কাউকে দেখিনি। তাই পাশে বলতে কাছাকাছি থাকা বা দূরে থেকে সোশাল মিডিয়ায় চ্যাট করাটাই বুঝেছি।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত একটা ছবি দাঁড় করালাম। স্যার আবার গম্ভীর স্বরে বিষয়বস্তু জানতে চাইলেন। বললাম, কলকাতার এক বড় ক্লাবের জন্মদিন উপলক্ষে দরিদ্র মানুষদের মধ্যে পোশাক বিতরণ করছে ফ্যান ক্লাবের সদস্যরা। এদের অনেকেই এখনও চাকরি–বাকরি পায়নি। নিজেদের পয়সা আর অমূল্য সময় নষ্ট করছে এই গরীব মানুষগুলোর জন্য।
আচ্ছা, এরা কি এটিকে?
স্যারের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, এ টি কে, ও টি কে, সেটিকে জাতীয় গজিয়ে ওঠা ক্লাবের সমর্থকেরা নয়। কেউ লাল হলুদ, কেউ সবুজ মেরুন, কেউ বা সাদা কালো। আপনি যাঁদের কথা ভাবছেন, তাঁদের হয়ে দালালি করার কিছু মানুষ থাকতে পারে। কিন্তু সমর্থক নয়।
সম্পাদক মশাই বললেন, তাহলে যুবভারতীতে ওই দলের খেলা কারা দেখে?
বললাম, যারা ফ্রি–তে টিকিট পায়। ওটাও একধরনের বিনি পয়সার পালা।
স্যার বললেন, এই ক্লাবগুলোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকো তুমিও। পাশে থাকার মানে তো এরাই শেখালো।