এত মিল, তবু কাল্পনিক?‌

বিপ্লব মিশ্র

যাঁর ফাঁসি হচ্ছে, তাঁর নাম ধনঞ্জয় চ্যাটার্জি। ১৯৯০ সালে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ফাঁসি। মেয়েটির পদবী পারেখ, বাড়ি ভবানীপুর থানা এলাকায়। ছেলেটির বাড়ি বাঁকুড়ার ছাতনায়।
ঘটনাগুলো চেনা মনে হচ্ছে?‌ চরিত্রগুলো চেনা মনে হচ্ছে?‌ কিন্তু পরিচালক অরিন্দম শীলের মনে হয়নি। এতকিছুর পরেও শুরুতেই তাঁর দাবি, সব ঘটনা কাল্পনিক। সব চরিত্র কাল্পনিক। কোথাও কোনও মিল থাকলে তা নাকি নেহাতই কাকতালীয়। শুধু কাল্পনিক হলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু ওই যে, অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর। তাই কিছু সত্যের সঙ্গে কিছু মনগড়া বিষয়কে এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, দর্শক বিভ্রান্ত হতে বাধ্য। মনে হতেই পারে, কী জানি, হয়ত এমনটাই হয়েছিল। এমনটাও তো হতেই পারত।

arindam shil
ছবির নাম ধনঞ্জয়। গত কয়েক মাস ধরেই এই ছবি নিয়েই চলছে জোর চর্চা। সন্দেহ নেই, অরিন্দম এই সময়ের একজন সফল পরিচালক। এতদিন শবর, ব্যোমকেশ এসব নিয়েই চলছিল। হঠাৎ হাত দিলেন ধনঞ্জয়ের উপাখ্যানে। এই ছবির প্রতিপাদ্য হেথাল পারেখকে খুন করেছেন তাঁর নিজের মা। ধনঞ্জয়কে ফাঁসানো হয়েছে। ধনঞ্জয়ের বিচার প্রক্রিয়া চলেছে নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু অরিন্দমবাবু নিজেই আদালত বসিয়ে দিয়েছেন।
প্রথমেই বলে রাখি, ধনঞ্জয়ের ভূমিকায় অনির্বাণ ভট্টাচার্য যেমন অসাধারণ অভিনয় করেছেন, তেমনই তাঁর বাবার ভূমিকায় পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই আইনজীবী কৌশিক সেন ও মিমি চক্রবর্তীর অভিনয়ও তারিফ করার মতো। চিত্রনাট্য কোথাও কোথাও একঘেয়ে মনে হলেও অনেক গবেষণার ছাপ আছে। বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার মুন্সিয়ানা আছে। যার মুখে যে সংলাপ মানানসই, তাঁর মুখে ঠিক সেই সংলাপই আছে। যদি অন্য ভাবনা, অন্য সম্ভাবনাকে উস্কে দেওয়ার নিরিখে মাপা হয়, তাহলে বলতেই হবে, পরিচালক বেশ সফল।

dhananjoy2
তবে কতগুলি যুক্তি বেশ অসার মনে হয়েছে। তার দু একটি উল্লেখ করা যাক। ১)‌ গুজরাটি ভোট ব্যাঙ্কের জন্য নাকি ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হয়। এই বাংলায় বাঙালির চেয়ে গুজরাটি বেশি?‌ ভোটের অঙ্কেই যদি ফাঁসি নির্ধারণ হয়, তাহলেও গুজরাটিদের খুশি করতে একজন বাঙালি যুবককে ফাঁসি দেওয়া?‌ এটা কখনও সম্ভব?‌ এই রাজ্যে গুজরাটি ভোট ব্যাঙ্ক কি এতই বেশি?‌ ২)‌ মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী ফাঁসি চেয়েছিলেন বলেই নাকি ফাঁকি হয়েছে। হায় রে!‌ মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী একটি সভায় ফাঁসির পক্ষে বলেছিলেন রায় ঘোষণার অন্তত দশ বছর পরে। ৩)‌ নব্বই সালে তো হাতে গোণা কয়েকটি কাগজ, আর টিভি বলতে সবেধন নীলমণি দূরদর্শন। তখন মিডিয়ার এত ভিড় হল কীভাবে?‌ তখন কি এখনকার মতোই প্রেস মিট হত?‌ ৪)‌ মুখ্যমন্ত্রী নাকি বলেছিলেন, ফাঁসি না হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। কোথায় বলেছিলেন, কোন কাগজে বেরিয়েছিল, জানা নেই। ৫)‌ তখন যিনি সব ব্যাপারেই মন্তব্য করতেন, গর্জে উঠতেন (‌এখন যিনি যাবতীয় অনুপ্রেরণার উৎস)‌, তাঁর ভূমিকা তখন কী ছিল?‌ তিনি কাদের পক্ষে ছিলেন?‌ নিহত হেথাল পারেখদের নাকি ধনঞ্জয়দের?
এমন অনেক প্রশ্ন তোলাই যায়। তবু মোটের উপর ছবিটি ভাল। গবেষণার ছাপ আছে। পরিশ্রম আছে। পরিচালকের কাছে আর্জি, নিজের মতো করেই ছবি করুন। বিকল্প ভাবনাকে উস্কেও দিন। কিন্তু বিশেষ কাউকে খুশি করতে গিয়ে সত্য–‌মিথ্যার এমন ককটেল নাইবা বানালেন। ওই খুশি করার অংশটুকু বাদ দিলে ছবিটার বিশ্বাসযোগ্যতা আরও বাড়ত।

sejuti-banner

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.