সেই কলমের আজও বিরাম নেই। বিরাম নেই ঘোরাঘুরির। এই বয়সেও যেন পায়ে চাকা লাগানো আছে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের। এবার তিনিই পাচ্ছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। পুরস্কার যেন তার সঠিক ঠিকানা খুঁজে নিল। লিখেছেন সংহিতা বারুই।
তখনও বাঙালির জীবনে এসে পড়েনি স্মার্টফোন নামক উপদ্রব। এমনকী মোবাইল শব্দটাও ডিকশেনারিতে প্রবেশ করেনি। বাঙালি কিশোরের চাহিদাটাও অন্যরকম ছিল। পুজো এলেই তারা বসে পড়ত নানা বই নিয়ে। কখনও শুকতারা, কখনও আনন্দমেলা। ওই বয়সে সবাই কম–বেশি গোয়েন্দা হতে চায়। একদিকে সত্যজিতের ফেলুদা। অন্যদিকে সুনীলের কাকাবাবু। সেখানে তোপসে বা সন্তুর মতো চরিত্র থাকলেও নেহাতই সহকারী। কিন্তু সমানতালে ছুটছিল পান্ডব গোয়েন্দা। এখানে ওই খুদেরাই গোয়েন্দা। তারাই দুঃসাহসিক অভিযানে সামিল হচ্ছে। তারাই চোর–গুন্ডা পাকড়াও করছে। এভাবেই বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল পান্ডব গোয়েন্দা। বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্চুদের নিয়ে যেন জমাট সংসার। আর সঙ্গে পঞ্চু তো আছেই।
এদের দেখাদেখি কত লোক তার কুকুরের নাম রাখতে লাগল পঞ্চু। কত কিশোর পাড়ার টুকটাক সমস্যায় নেমে পড়ল গোয়েন্দা হয়ে। ফেলুদা বা ব্যোমকেশ বা কাকাবাবুর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ নেই। তারা অনেক বড়। তাদের অনেক বুদ্ধি, অনেক পরিচয়। এই খুদে কিশোরদের প্রেরণা তখন বাবলু, ভোম্বলরা। এমনকী মেয়েরাও যে গোয়েন্দা হতে পারে, বাচ্চু–বিচ্চুরা দেখিয়ে দিয়েছে। তারা এখান–ওখান বেরিয়ে পড়ে। বাড়ির লোকেরাও বাদা দেয় না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই পাহাড়, ওই জঙ্গলে চলে যায়। বাঙালি কিশোর পড়তে পড়তেই পৌঁছে যায় সেইসব অজানা ঠিকানায়। ভূগোল বই পড়তে যাদের ঘোর অনীহা, তারা পান্ডব গোয়েন্দার হাত ধরেই পৌঁছে গেল নানা অজানা ঠিকানায়। একদিকে গোয়েন্দা কাহিনীর থ্রিলার, অন্যদিকে মানস–ভ্রমণ।
সেই কলমের আজও বিরাম নেই। বিরাম নেই ঘোরাঘুরির। এই বয়সেও যেন পায়ে চাকা লাগানো আছে ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের। গতবছর বর্তমান পুজো সংখ্যায় অনেকেই পড়েছেন পান্ডব গোয়েন্দা। সাপ্তাহিক বর্তমানেও অন্যতম আকর্ষণ এই পান্ডব গোয়েন্দাই। গতবছর পুজো সংখ্যা হাতে পেয়েই পড়ে ফেলেছিলাম। এখনও সেই একইরকম মুগ্ধতা। এরই মধ্যে খবর পেলাম, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাচ্ছেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। ইদানীং পুরস্কার শুনলেই আমরা কেমন যেন সন্দেহের চোখে দেখি। মনে হয়, নিশ্চয় শাসকদলের মিছিলে হেঁটেছেন। তাই এই পুরস্কার। এমন কত লোককেই তো হাঁটতে দেখলাম। এই মানুষটা বরাবরই অন্যরকম। কখনও কাউকে তোয়াজ করেন না। শাসকদলের কোনও অনুষ্ঠানে যেতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। নিজের মতো লিখে যান, নিজের মতো ঘুরে বেড়ান। আজও ছোটদের সঙ্গে কী অনায়াসে মিশে যান। ছোটরাই যেন তাঁর সঙ্গী। এমন মানুষের নাম কে সুপারিশ করল, কে জানে! এমন পুরস্কারের খবর শুনে বর্ষীয়াণ সাহিত্যিক নিজেও নিশ্চয় বিস্মিত। আসলে, সরকারি স্বীকৃতি জুটল কী জুটল না, তাতে প্রকৃত স্রষ্টার তেমন কিছু যায় আসে না। পাঠকদের ভালবাসা যে মস্তবড় এক স্বীকৃতি। যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম আঁকড়ে ধরে আছে। সেদিনের কিশোর আজ হয়ত দাদু হয়ে গেছেন। কিন্তু এখনও তাঁর নস্টালজিয়াজুড়ে থেকে গেছে সেই পান্ডব গোয়েন্দা। তিনি হয়ত তাঁর নাতিকে এই বই ধরিয়ে দিচ্ছেন। ভালবাসার ব্যাটনটা এভাবেই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। এমন মানুষ যখন পুরস্কার পান, তখন পুরস্কারের উপরেও কেন জানি না শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। অনেককিছুই তো ভুল ঠিকানায় পৌঁছে যায়। অন্তত এই পুরস্কার তার ঠিকানা ঠিক খুঁজে নিল।
(বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে, তাঁর সাহিত্য নিয়ে আমরা আরও কিছু লেখা প্রকাশ করতে আগ্রহী। সেই লেখাগুলিই হয়ে উঠুক বেহ্গল টাইমসের শ্রদ্ধার্ঘ্য। আপনারাও লিখতে পারেন এই বর্ষীয়াণ সাহিত্যিকের কথা। পান্ডব গোয়েন্দাকে ঘিরে আপনাদের নস্টালজিয়ার কথা। পাঠিয়ে দিন আমাদের ঠিকানায়। ঠিকানা: bengaltimes.in@gmail.com )