ভরসা থাকুক বেলাশেষের আজানে আর শাঁখের সুরে

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

হে বঙ্গ আজ তুমি ধরা দিলে এ কেমন রূপে,
চোখ মেলে দেখি র‍য়েছি বসে বারুদের স্তুপে।

হ্যাঁ, আজ আর সারা ভারতের কাছে গর্ব করে বলার জায়গা নেই,আমি বাঙালি। আমার পায়ের নিচে আর বিছানো নেই কুসুমাস্তীর্ণ পথ। বরং তা হয়ে দাঁড়িয়েছে রক্তে পিছল শ্মশান , গোরস্থানের পথ। আমার চারিদিকে আর শঙ্খধনি, আজানের সুর শোনা যায় না। বরং আকাশ বাতাস রণিত করে থাকে গোলা বারুদের শব্দ—অসির ঝনঝনানি, উদ্ধত ত্রিশুলের রক্তপিপাসু আস্ফালনের আওয়াজ।
sampriti2
বাংলায় তো কখনও এরকম ছিল না? এখানে প্রতিটি সম্প্রদায়ের মিলনতীর্থ—বছরের পর বছর এই ধারা মেনে বজায় থাকতো। এ বাংলা রবি ঠাকুরের বাংলা যেমন, তেমনি এ বাংলা কাজি নজরুলেরও বাংলা ছিল। আবার এ বাংলা বিশ্বশান্তির মূর্ত প্রতীক মাদার টেরিজার বাংলাও হয়েছিল একদিন। এ বাংলা গানে, কবিতায়, ফুটবলে, আড্ডায় মেতে থাকার বাংলা। এই তো বাংলার সংস্কৃতি ছিল। এর জন্যই সারা ভারতবর্ষের কাছে বাংলা বা পশ্চিমবঙ্গ অনন্য ছিল। আর আজ ? ভাবতে পারেন একটা ১৭-১৮ বছরের ছেলে, যার জীবনের ক্যারিয়ার গড়ার মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত, সেই সময় সে ধর্মীয় অন্ধত্বের দ্বারা, হিংস্রতার দ্বারা লালায়িত। জন্মসূত্রে হয়তো সে কোনও একটি সম্প্রদায়ভুক্ত, কিন্তু তা বলে এত হিংসা, এত বিদ্বেষ, এত বিজাতীয় ঘৃণা অন্য আর একটি সম্প্রদায়ের প্রতি, যে তাদের ভক্তির, শ্রদ্ধার কোমল জায়গায় এই কুরুচিকর আঘাত ? আর তার এই খামখেয়ালী বা ইচ্ছাকৃত সর্বনাশা খেলার ফলে কয়েকশো নিরপরাধ শান্তিকামী সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হল। উপরন্তু সেই কুরুচিকর ছবিটি একে ওকে দেখিয়ে এর শ্রেণির “ছিদ্রান্বেষী নরকীট” সমাজটার বুকে হিংসার আগুন জ্বালতে উসকে দিল। এর নেপথ্যে কারা ? কাদের ইন্ধন এই বিষ ছড়ানোর পেছনে ? কারা মদত জোগায়? একটা ১৭-১৮ বছরের তরুণ তো এতটা হীনচেতা হতে পারে না !! জীবনের কতটা দেখেছে সে ? ধর্মের মানে সে আদৌ ভাল করে বোঝে? তার তো এ সময় পড়াশোনা করার বয়স, শিক্ষালাভের বয়স। অবসর সময়ে খেলাধূলা করার, সিনেমা দেখার, বেড়াতে যাওয়ার, বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা দেওয়ার বয়স। যতটুকু শুনলাম সংবাদপত্রের মাধ্যমে সে তথাক্থিত ভদ্র,সভ্য,রুচিশীল পরিবারের সন্তান। নিশ্চয় তার পিতামাতা তাকে এই কুশিক্ষা দিতে পারেননা কখনো । তাহলে কি করে সে এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠলো? কাদের সান্নিধ্যে আজ সে এই বিপথগামী ?

sampriti3

বস্তুতই সমাজটা শেষ হতে চলেছে এক শ্রেণীর বর্বর,আদিমপ্রবৃত্তিসম্পন্ন নরপশুদের হাতে। এরাই বিভেদ আনে, এরাই দাঙ্গার আগুন লাগায়, এরাই গুজরাটে গর্ভিণীর জরায়ু ছেদন করে অন্তস্থ ভ্রূণ বাইরে এনে তাকে ত্রিশুলে গেঁথে পৈশাচিক উল্লাসে মাতে, এরাই বাংলাদেশে শয়ে শয়ে পরিবারকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয় । এদের আর কোনও পরিচয় নেই। এরা শুধু মৌলবাদী। ধর্মের অন্ধত্বের বিষ এদের রক্তে। এই বিষ সারা ভারতে আগে থেকেই ছিল। ভাবতে লজ্জা হয় আজ সোনার বাংলাতেও সেই বিষ ঢুকে গেছে। আর তাকে মদত দিচ্ছে বাংলার সরকার আর কেন্দ্রের সরকার দুই সরকার মিলে। দুজনেরই এক একটি সম্প্রদায়ের প্রতি সীমাহীন পক্ষপাত। আর তার মূলে আজকের বসিরহাট, বাদুড়িয়ার এই শিউরে ওঠার মতো ঘটনা।

সমাজ়ের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিশিষ্ট মানুষেরা আজ সমাজের এই ক্ষত অপনয়নে এগিয়ে আসুন। আপনাদের শিক্ষা, রুচি, সংস্কৃতির আলোকে আলোকিত করুন এই দুর্ভাগাদের। বুঝিয়ে দিন এই বাংলা সবার। রবি ঠাকুরের যেমন ছিল, আছে আর থাকবে। নজরুলেরও তেমনি ছিল, আছে আর থাকবে। এখানে রাম আর রহিমের পরস্পরের আত্মার যোগ। এই ঐক্য, এই সংহতি, এই ঐতিহ্য বজায় থাকুক আগামী দিনে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.