নাটক লেখা, নির্দেশনা, অভিনয়। তিন ভূমিকতেই উজ্জ্বল। আর পর্দার অভিনয় তো আছেই। তারও বাইরে চন্দন সেন মানে জোহুজুরের ভিড় থেকে দূরে, মাথা উঁচু রাখা, সহজ কথাটা সহজভাবে বলা একটা মানুষ। অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক। নানা বিষয় উঠে এল একান্ত আলাপচারিতায়। তাঁর মুখোমুখি অয়ন দাস।।
নিজের নাটকে স্বামী বিবেকানন্দকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হোক কিংবা ভূতের রাজার কাছে ‘বর’ হিসেবে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি কমে যাবার ‘শিশুসুলভ’ ইচ্ছা হোক অথবা ‘সমাজসচেতক’ হিসেবে এই ধরাধামে অরাজনৈতিক জীবন কাটানো অসম্ভব- এই দৃঢ় বিশ্বাসই হোক, চন্দন সেনের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এলো তাঁর স্মৃতি,প্যাশন,আক্ষেপ,বাসনা।
প্রশ্ন: আপনি অনূর্ধ্ব বাংলা উনিশ দলে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নাটক ও ক্রিকেটের মধ্যে নাটককে বেছে নিলেন কেন? নাটকের প্রতি ভালোবাসা কীভাবে গড়ে উঠল?
চন্দন সেন: ছোটবেলা থেকেই নাটকের প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল। পরিবারেই নাটকের পরিবেশ ছিল। ক্রিকেট ও নাটক দুটো একসঙ্গে বজায় রাখতে সমস্যা হচ্ছিল, থিয়েটারে ‘ফেল’ করছিলাম। তাই শুধু নাটকেই মনোনিবেশ করেছিলাম।
প্রশ্ন: থিয়েটার, সিনেমা, সিরিয়াল- তিনটি মাধ্যমেই আপনি চুটিয়ে কাজ করেছেন। কোন মাধ্যমে আপনি অভিনয় করতে বেশি পচ্ছন্দ করেন?
চন্দন সেন: অবশ্যই থিয়েটার। তবে তিনটি মাধ্যমেরই নিজস্ব নিজস্ব ব্যকরণ আছে। সেই ব্যকরণ সবাইকে জানতে হয়, সেটা জানা না থাকলে মুশকিল হয়।
প্রশ্ন: আপনি বলেছিলেন ‘সিনেমা, টেলিসিরিয়াল হল আপনার Bread and Butter’। বর্তমানে সিনেমা, সিরিয়ালে অভিনয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রঙ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে?
চন্দন সেন: আমার ক্ষেত্রেই এটা বছর দুয়েক হয়েছিল ২০১১-২০১৩ তে। টানা দুবছর তেমন কাজ ছিল না, ছোট খাটো কাজ করে চালাতে হচ্ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেরকম কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।
প্রশ্ন: ‘যুগনায়ক’-এ কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দলের শাসনকালে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে আপনি স্বামী বিবেকানন্দকেই বেছে নিলেন কেন?
চন্দন সেন: প্রথমত, কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল ক্ষমতায় আসার আগেই আমি নাটকটি লিখেছিলাম।
দ্বিতীয়ত, নাটকটি লিখেছিলাম সামগ্রিক ভারতীয় পরিস্থিতিকে তুলে ধরার জন্য। তো সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দকে যেভাবে দেখানো হয় সেভাবে তাঁকে উপস্থাপিত না করে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করি। সমাজ-বিপ্লবী, সমাজ-সংস্কারক হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দের যে ভূমিকা আছে তা আমার কাছে খুব আকর্ষণীয়। আর সেটাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন: আপনি বরাবরই সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নাটক লেখেন, পরিচালনা করেন। সেইসব সামাজিক নাটকগুলি যে উদ্দেশ্য নিয়ে করেন তা কি সফল হয়?
চন্দন সেন: প্রথমত, আমাদের নাটকের টিকিট তো বেশি বিক্রি হয় না। তাতে মনে হয়, আমরা যে প্রচেষ্টা করছি, সেটা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, কেউ-ই অরাজনৈতিক নাটক করেন না। পৃথিবীর বুকে কেউ যদি অরাজনৈতিক শিল্পসাহিত্য সৃষ্টি করেন কিংবা অরাজনৈতিক জীবনযাপন করেন তাহলে তাঁর থেকে শিখে আসবো।
প্রশ্ন: আপনি উৎপল দত্ত, রামাপ্রসাদ বণিককে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সেই সময়ের থেকে এখন বাংলার থিয়েটারে কী কী পরিবর্তন হয়েছে?
চন্দন সেন: তখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বুকে ‘আমরা’ নিয়ে একটা ধ্যান-ধারণা ছিল, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল। সেটা যতোই ‘Fake’ হোক না কেন। ফলে দর্শকও সেভাবে ভাবতেন। কিন্তু এখন অনেক বেশি ‘আমি’ কেন্দ্রিক। তাই দর্শকও পাল্টে যাচ্ছেন। তাঁরা ‘Content’-এর থেকে ‘অলঙ্কার’ নিয়ে অনেক বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন। সেট কেমন হল, লাইটিং কেমন হল, অভিনয় কেমন হল-তা নিয়ে দর্শক বেশি আগ্রহী। আগেও ‘অলঙ্কার’-এর দরকার ছিল, কিন্তু তার সাথে ‘Content’ ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে কিছু মানুষ এই ধারার ব্যতিক্রম। সেজন্যই বোঝা যায় যে ‘Content’-ই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়।
প্রশ্ন: থিয়েটারের ক্ষেত্রে বলা হয় যে সবচেয়ে ভাল অভিনেতারাই থিয়েটারে কাজ করেন। তা সত্ত্বেও বাকি দুই মাধ্যমের তুলনায় থিয়েটারকে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়?
চন্দন সেন: না, আমি মনে করি না যে থিয়েটারে সবচেয়ে ভালো অভিনেতারাই অভিনয় করেন। কয়েকজন আছেন যাঁরা অত্যন্ত দক্ষ অভিনেতা। প্রতি জেলায় যদি দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে নগণ্য কিছু ভাল অভিনেতা আছেন।
প্রশ্ন: থিয়েটার অনেক বেশি কলকাতা-কেন্দ্রিক। জেলায় জেলায় নাটক ছড়িয়ে দেবার জন্য কী করা দরকার?
চন্দন সেন: কিচ্ছু করা যাবে না। সরকারের তরফে বা কোনও সংগঠনের উদ্যোগে এগুলি করতে হয়। কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজটি করতে পারেন। কিন্তু তার বাইরে কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না।
প্রশ্ন: আপনি বলেছিলেন- থিয়েটার Financially Sustainable নয়। থিয়েটার ডিমানিটাইজেশনের ধাক্কা থেকে কতটা ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে?
চন্দন সেন: যাঁদের নাটক মানুষ দেখছেন তাঁদের নাটক মানুষ আগেও দেখছিলেন, এখনও দেখছেন। ওরকমভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর কিছু নেই।
প্রশ্ন: নাটকের ‘Slot’ পাওয়া নিয়ে কখনও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন?
চন্দন সেন: না, আমার তা মনে হয় না। তবে সবসময়েই নতুন কোনও সরকার ক্ষমতায় এলে এবং পূর্ববর্তী সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে একটা ‘Retaliation’ হয়। কিছু কিছু লোক তাঁরা নতুন করে ক্ষমতায় বসে তাঁদের মতো করে পুরোটা পরিচালনার চেষ্টা করেন। সারা পৃ্থিবীতেই তাই হয়। যিনিই নতুন ক্ষমতায় আসুন না কেন তাঁরা নিজেদের মতাদর্শ অনুযায়ী ‘কাছের-দূরের লোক’, ‘আমরা-ওরা’ ঠিক করে নেন।
প্রশ্ন: বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের ভূয়সী প্রশংসা-তা সত্ত্বেও জীবনের প্রতি মুহূর্তে ‘Struggle’। কীভাবে এই প্রতিকূলতাকে জয় করার অনুপ্রেরণা পান?
চন্দন সেন: আমার মনে হয় না আমি দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য। আমার যদি তেমন গ্রহণযোগ্যতা থাকত তবে যাঁরা সিনেমা তৈরি করেন তাঁরা আমায় নিতেন। কিন্তু তাঁরা আমায় নেন না। এথেকেই প্রমাণিত হয় আমি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য নই। যাঁদের কাছে আমি গ্রহণযোগ্য তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার সাথে সাথে একজন অভিনেতার গ্রহণযোগ্যতা আপামর জনসাধারণের কাছে না হলে তা ব্যর্থতা বলেই প্রতিরূপ হয়। কমবয়সী দর্শক থেকে বয়স্ক দর্শক প্রত্যেকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা যদি থাকত, তাহলে ভাল হত।
প্রশ্ন: আপনার দীর্ঘ নাট্যজীবনে কি কোনও আক্ষেপ আছে?
চন্দন সেন: প্রচুর আক্ষেপ আছে। যেভাবে থিয়েটার করতে চাই, সেভাবে করতে পারি না। সেটা সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতির কারণে। সবচেয়ে বড় আক্ষেপ হল নিজের প্রতি। যতটা ‘Updated’ হওয়া উচিত ছিল ততটা ‘Updated’ হতে পারিনি।
প্রশ্ন: আপনি দীর্ঘদিন বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত,বর্তমানে বাংলায় বামেদের এই শোচনীয় অবস্থার কারণ কী? মানুষের থেকে কি তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন?
চন্দন সেন: সে তো রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁরা বুঝবেন। বামেরা ক্ষমতায় এসেছিল বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে। এখন তাঁরা বাম রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে ভোটের রাজনীতি করছেন। বাম রাজনীতি বরাবরই দ্বি-স্তরীয়- সংসদীয় রাজনীতি ও মানুষের মধ্যে, যেটা বাড়াতে হবে। তবেই আবার মানুষের মধ্যে যদি গ্রহণযোগ্যতা তৈ্রি হয়। তবে তা সুদীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমেই হবে।
প্রশ্ন: আপনি ভবিষ্যতে কী কী নাটক পরিচালনা করছেন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
চন্দন সেন: আমারই একটা পুরোনো নাটক ‘উড়াল’ করব। আগে একটা শো হয়েছিল, এখন আবার করা হবে। তাছাড়া Sartreর ‘Men Without Shadows’ নিয়ে একটি ‘অ্যাডাপ্টেড’ নাটক করার ঠিক আছে।
প্রশ্ন: ভূতের রাজা তিনটে বর দিলে কী কী চাইবেন?
চন্দন সেন: প্রথমত, পৃথিবীর এখন যে তাপমাত্রা তার থেকে ৬ ডিগ্রি কমে যাবার বাসনা করি।
দ্বিতীয়ত, কর্পোরেট রাজের বিলুপ্তি।
তৃতীয়ত, ভারতের প্রতি ঘরে প্রকৃত শিক্ষা বিস্তার এবং বেকার ছেলেমেয়েদের চাকরি।