প্রসূন মিত্র
হঠাৎই যেন ভাইরাল হয়ে গেল একটি ছবি। পুলিশের দিকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ছেন সিপিএমের তরুণ নেতা শতরূপ ঘোষ। কারা কী উদ্দেশ্যে ছবিটি ছড়িয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হয় না। পরেরদিন একটি কাগজে (দিদিমণিকে খুশি করতে বামেদের মুণ্ডপাত যে কাগজের একমাত্র লক্ষ্য) দেখলাম, সেই ছবি ছাপাও হয়েছে। প্রতিবেদনের ভাষা যেমন হওয়ার কথা, তেমনই হয়েছে। তরুণ নেতাকে প্রায় সন্ত্রাসবাদীর তকমা দিতেই বাকি রেখেছে।
আমি নিজেও একজন বাম সমর্থক। বয়স এখনও চল্লিশ পেরোয়নি। অর্থাৎ, আমাকে বোধ হয় এখনও বৃদ্ধদের দলে ফেলা যায় না। আমার নিজের কিন্তু ছবিটি দেখে ভালই লেগেছে। হ্যাঁ, ওদের পাথর তুলে নেওয়াকে আমি সমর্থন করি। পুলিশ নির্বিচারে লাঠি চালালো। বয়স্ক থেকে মহিলা, প্রতিবন্ধী থেকে স্কুলপড়ুয়া— কেউ বাদ গেল না সেই আক্রমণ থেকে। বাদ গেলেন না সাংবাদিকরাও। কই, এসব নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্চ তো দেখলাম না। এসব ছবি ছাপার সাহসও লেজুড় মিডিয়া দেখাতে পারল না। অথচ, এমন অন্তত দশ হাজার ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়। সোশাল মিডিয়া নিয়ে আমরা যতই ব্যঙ্গ–বিদ্রুপ করি, এই মিডিয়াই অনেক সময় সঠিক ছবিটা তুলে ধরছে। বাজারি কাগজ বিজ্ঞাপনের জন্য নিজেদের মেরুদণ্ড অনেক আগেই বিক্রি করে দিয়েছে। সোশাল মিডিয়ায় অন্তত মানুষ নিজের কথা বলতে পারছে। নিজের ঘৃণা, রাগ উগরে দিতে পারছে।
সেখানেই প্রথম ছবিটি চোখে পড়ল। মনে একটু আশঙ্কা ছিল, কী জানি, আবার এটাকে নিয়ে হইচই না শুরু হয়ে যায়! পরে দেখলাম, আমার মতো অনেকেই এটাকে বেশ ভালভাবেই গ্রহণ করেছে। পুলিশ যদি নৃসংশতা দেখাতে পারে, তাহলে পাল্টা পাথর ছোঁড়ার মধ্যেও কোনও অন্যায় দেখি না। এই শতরূপদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা নাকি মাঠে নামে না। তারা নাকি ঠান্ডা ঘরে বসে রাজনীতি করে (যদিও সেই অভিযোগের তেমন ভিত্তি নেই। তবু কিছু একটা অভিযোগ তো তুলতে হবে। তাই এতদিন এগুলো বলা হত। ভোটের পর আরও অনেক কর্মীর মতো তাঁর বাড়িও কিন্তু আক্রান্ত হয়েছিল।)। আর আজ কিনা বলা হচ্ছে, মিছিল থেকে পাথর ছোঁড়া হচ্ছে কেন? যাক, তাহলে এরা মাঠে নামে, এটা তো স্বীকার করলেন। একটি ছবি এক লহমায় অনেক অপবাদ মুছে দিয়ে গেল।
সেদিন মিছিলে বয়স্ক মুখ ছিলেন ঠিকই। কিন্তু তরুণ প্রজন্মও কিন্তু কম ছিল না। এরা ঘরে বসে ফেসবুক বিপ্লব করেনি। চড়া রোদেও দূরদূরান্ত থেকে এসেছে। পুলিশের মার খেতে হবে জেনেও পিছিয়ে যায়নি। কী দায় ছিল এদের আসার? এলে চাকরি হবে? বরং, হওয়া চাকরি আটকে যাবে। পাড়ায় বিদ্রুপ শুনতে হবে, এমনকী বাড়ি থেকেও মৃদু বাধা আসতে পারে। তা সত্ত্বেও ওরা এসেছে। ওরা মিছিলে স্লোগান তুলেছে। পুলিশের উদ্যত লাঠির মুখে পালিয়ে যায়নি। বুক চিতিয়ে লড়াই করেছে, মার খেয়েছে।
শতরূপ বা সামনের সারির নেতারা সেদিন নিরাপদ দূরত্বে ছিল না। মানুষের মাঝেই ছিল। লাঠির মুখোমুখিই ছিল। তাদের লক্ষ্য করেও লাঠি চালানো হয়েছে, ঢিল ছোঁড়া হয়েছে। কই, সেসব ছবি তো ছাপা হল না। হ্যাঁ, সেই ঢিলই তাদের মতো কেউ কেউ ফিরিয়ে দিয়েছিল অন্য শিবিরে। সেদিন ভাবমূর্তি রক্ষায় এরা পিছিয়ে যায়নি। কে কী ভাববে, তাই ভেবে গুটিয়ে যায়নি। আরও হাজার হাজার তরুণ যা করেছে, এরাও সেই পথই বেছে নিয়েছে। নজরুলের জন্মদিনে হঠাৎ একটা লাইন মনে পড়ে গেল— সাবধানীরা বাঁধ ভাঙে সব/আমরা ভাঙি কূল। সাবধানীরা ভাবুন। কে কী ভাববে, কে কী বলবে, সমালোচনা হতে পারে, শোকজ হতে পারে, ভাবমূর্তিতে দাগ পড়তে পারে, এই ছবি বেরিয়ে গেলে মামলা হতে পারে, ভবিষ্যতে টিকিট পেতে সমস্যা হতে পারে। এসব কোনওকিছুই সেইমুহূর্তে সে ভাবেনি। তরুণদের এসব ভাবার দায় নেই। তারা তাদের মতো করেই চলুক। যে ভাষা শাসক বোঝে, সেই ভাষাতেই তারা কথা বলুক।