সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
প্রত্যাশিতই ছিল। আর তাই সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জামিনে আমি একটুও অবাক নই। কারণ, বর্তমানে দেশে “বিচার” শব্দটা একটা প্রহেলিকার মতই হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেটা বাংলার শাসক দলের নেতা –নেত্রীদের ক্ষেত্রে একেবারে ষোল আনা খাঁটি। তাঁদের আবার আইন-আদালতের সামনে দাঁড়ালেই বহির্জগতের যত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া আছে, সব যেন এসে শরীরে বাসা বাঁধে। আর আদালতের নির্দেশে তদন্ত প্রক্রিয়া চালু থাকলেই, অর্থাৎ “বিচারাধীন বন্দী” হলেই তার ঠিকানা হয় সরকারি হাসপাতাল। কিন্তু এতসব নাটকের পরেও তাদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে বৈকি !! কারও ২ মাস, কারও ৪ মাস, কারও আবার ১ বছর কী ২ বছর “রোগী” সেজে সরকারি হাসপাতালে “বায়ু পরিবর্তনের” পরে কোনও এক মন্ত্রবলে সব অপরাধ—তা সে যতই গুরু হোক না কেন, লাঘব হয়ে যায়। আর আশ্চর্যজনকভাবেই আদালত থেকে জামিনের ফতোয়াও চলে আসে। এটাই এখন রাজনৈতিক নেতাদের, মানে বাংলার শাসকদলের নেতাদের জন্য “পরিবর্তিত আইন-কানুন” বা সংবিধান!
আসলে আদালতের আর দোষ কী ? আদালত নির্দেশ দেয় মাত্র। তার কাছে সমস্ত প্রমাণ দাখিল করার গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত আইনজীবীদের কাছেই। তাদের সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই অপরাধের গুরুত্ব বুঝে আদালত দণ্ড দেয়। কিন্তু সেই সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা এবং সঠিক সময়ে তা আদালতের কাছে পেশ করার মধ্যে যদি ফাঁক ফোকর থাকে আর বলাবাহুল্য সেই ফাঁকফোকরটা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয় বা বিশেষ কোনও প্রভাবশালীর অঙ্গুলিহেলনে সেই সাক্ষ্যপ্রমাণ সগ্রহ এবং তা আদালতের কাছে দাখিল করা — এই প্রক্রিয়াই ব্যাহত হয়, তখন আদালতের আর দোষ কী ? সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আজ এই “অলিখিত বোঝাপড়া”র কারণেই জামিনে মুক্ত। আর এই বোঝাপড়া অবশ্যই কেন্দ্রের শাসকদল ও বাঙলার শাসকদলের মধ্যে, যা সারদা চিটফাণ্ড দুর্নীতির মামলা থেকে একের পর এক চলেই আসছে। সারদা মামলাতে অভিযুক্ত তৃণমূলের নেতা মন্ত্রীরা সবাই একে একে জামিন পেয়েছে এই সখ্যতার কারণে। অথচ সেই চিটফান্ডে টাকা রেখে প্রতারিত হাজার হাজার প্রতারিত, সর্বস্বান্ত মানুষের হাহাকার, অশ্রুপাতের কোনও প্রতিকার হয়নি আজ পর্যন্ত। আর এবারে এই রোজ ভ্যালি কাণ্ডেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অথচ ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে বর্তমানে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দ ল বি.জে.পির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন যে বি.জে.পি ক্ষমতায় এলে সবকটি চিটফাণ্ডে টাকা রেখে প্রতারিত হওয়া লক্ষ লখ মানুষের টাকা পুনরুদ্ধার করা হবে আর সেই সঙ্গে সেই টাকা আত্মসাৎকারীদেরও গ্রেফতার করে উপযুক্ত বিচার প্রক্রিয়া চালানো হবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মধ্যেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা সি.বি.আই কে কার্যত বশ করে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। তাদের অঙ্গুলিহেলনেই চলছে সি.বি.আই। কখনও কখনও নিজেদের কর্মদক্ষতা দেখাতে সি.বি.আইকে তৎপর করে বাংলার ক্ষমতাসীন দলের দু একজন নেতা মন্ত্রীকে জেরা করার সমন পাঠানো বা জেরা করে গ্রেফতার করা আর তার পরে আদালতে হাজির করিয়েও উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ সঠিক সময়ে পেশ না করা আর ইচ্ছাকৃত দুর্বল যুক্তি যেগুলো নিজেরাও জানে যে ধোপে টিকবে না তা সাজিয়ে সেই “বিচারাধীন বন্দী”র মুক্তির পথ প্রশস্ত করা—-সি.বি.আই তথা কেন্দ্রের গোয়েন্দা দপ্তরের এখন এটাই কর্মসূচী। অথচ তাঁরা কি নিজেদের কাজ করার স্বাধীনতা পেলে পারতেন না এইসব প্রতারকদের অপকীর্তির স্বপক্ষে বলিষ্ঠ প্রমাণ সংগ্রহ করে এবং সঠিক সময়ে তা আদালতে পেশ করতে ? একথা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? আসলে “খাঁচাবন্দী তোতাপাখি” র যেমন ওড়ার স্বাধীনতা নেই, পিঞ্জরাবদ্ধ হয়েই তার দিন কাটে, তেমনি সি.বি.আই–ও আজ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক শিকলে আবদ্ধ। তাদেরও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
তাই প্রশ্ন একটাই। দেশে কি আদৌ কোনও বিচার ব্যবস্থা রয়েছে? যে চিটফান্ডে টাকা রেখে কয়েক লাখ মানুষ প্রতারিত হল, শতাধিক মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিল, কয়েক হাজার পরিবার সর্বস্বান্ত হল, সেই বুভুক্ষু, হতদরিদ্র, হতভাগ্য মানুষজনের চোখের জলের কি কোনও দাম নেই ? তারা কি সুবিচার পাবে না ? তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত সঞ্চয়কে যে “নরপশু” রা ছলে-বলে, কৌশলে আত্মসাৎ করল, আইনকে এইভাবে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে তারা নিস্কৃতি পেয়ে যাবে ? তাহলে গণতান্ত্রিক দেশের আইন-কানুন, বিচার ব্যবস্থা বলে আর বাকি থাকলো কি ?