সন্ত্রাস কাকে বলে, এবার বুঝলেন, সুশান্তরঞ্জন!

সেই সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়কে মনে আছে?‌ ঠিক ধরেছেন, আগের পুরভোটে তিনিই ছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার। প্রথমে বলেছিলেন, কোথাও সন্ত্রাস হয়নি। পরে সন্ত্রাস কাকে বলে, নিজে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। সেই সময় তাঁকে লেখা একটি খোলা চিঠি। ফের তুলে আনা হল বেঙ্গল টাইমসে।লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।
সাতের দশকের কলকাতা ময়দান। ইস্টবেঙ্গলের রিক্রুটার ছিলেন জীবন চক্রবর্তী, পল্টু দাস। কর্তারা যাঁকে তুলে আনতে বলতেন, ওঁরা ঠিক তুলে আনতেন। কখনও তাঁর বাবা-মায়ের হাতে পায়ে ধরে, আবার কখনও ধমক দিয়ে।যার ক্ষেত্রে যেটা দরকার।
তেমনই এক ফুটবলারকে এনে সই করিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলে। একটি ম্যাচে সেই ফুটবলার একটি সহজ গোল মিস করলেন। হাফ টাইমে মাঠে নেমে গেলেন জীবন চক্রবর্তী। রাগ সামলাতে না পেরে বলেই ফেললেন, আমরা ছেলেধরা। যাকে ধরে আনতে বলে, এনে দিই। কে কেমন ফুটবলার, আমরা অত বুঝি না। কিন্তু তুই তো বুঝিস, ইস্টবেঙ্গলে খেলার যোগ্যতা তোর নেই। তাহলে, সেদিন বলিসনি কেন ?
সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়কে দেখে বারবার সেই জীবন চক্রবর্তীর কথা মনে পড়ে যায়। বলতে ইচ্ছে করে, আপনার যে নির্বাচন কমিশনার হওয়ার কোনও যোগ্যতাই নেই, সেটা মমতা ব্যানার্জি না হয় বোঝেননি। কিন্তু আপনি তো বুঝতেন। আপনি সেদিন বলেননি কেন ?
তাঁর উপর কখনও রাগ হয়। কখনও তাঁকে দেখে হাসি পায়। আবার কখনও করুণাও হয়। তবু কখনও কখনও ভরসা রাখতে চেয়েছি। মনে হয়েছে, এবার অন্তত চক্ষুলজ্জাটুকু থাকবে। বুঝিয়ে দিয়েছেন, নির্লজ্জ স্তাবকতা ছাড়া আপনার কাছে আর কিছুই আশা করা যায় না।
এতদিন যে চেয়ারে বসতেন সিনিয়র আই এ এস-রা, সেই চেয়ারে বসানো হল আপনার মতো ডব্লু বি সি এস-কে। তখন বোঝেননি শাসক দল ঠিক কী চাইছে? মীরা পাণ্ডের মতো নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। এমন অফিসারদের যে দিদিমণির পছন্দ নয়। তাঁর দরকার আপনার মতো একজনকে, যিনি সযত্নে নিজের মেরুদন্ড বাড়ির আলমারিতে রেখে নতুন কাজে যোগ দেবেন (আদৌ সেটা ছিল কি, সেটাও বড় প্রশ্ন)।
রিগিং,ছাপ্পা এগুলো কি এই বাংলায় আগে হয়নি ? হ্যাঁ, হয়েছে। বাম জমানাতেও হয়েছে। তাই বলে এই নির্লজ্জ চেহারায়? আপনি জানতেন না, কী হতে চলেছে? প্রশাসন সেদিন কী ভূমিকায় থাকবে, নির্বাচন কমিশন কী ভূমিকা নেবে, সবাই জানত। যা ভাবা গিয়েছিল, তাই হয়েছে।
বেশি পুরানো কথা টেনে এনে লাভ নেই। শেষ তিন দিনের দু একটা উদাহরণ তুলে ধরা যাক। শনিবার সারা বাংলা দেখল, কী হয়েছে। আপনি বললেন, বুথের ভেতর কিছু হয়েছে, এমন অভিযোগ নাকি আসেনি। বিরোধীরা ধর্নায় বসলেন। গোটা দেশ ধিক্কার দিচ্ছে। ভাবলেন, কিছু একটা আশ্বাস দিয়ে শান্ত করা যাক। রবিবার বললেন, গণনা পিছিয়ে দিচ্ছি। রাহুল সিনহা ভাবলেন যুদ্ধজয় করে ফেলেছেন। বলে ফেললেন, ঐতিহাসিক ঘোষণা। জানতেন না, পরের রাতে কী হতে চলেছে।

sushanta ranjan2
কী হল? শিক্ষামন্ত্রী বলে বসলেন, আপনি সিপিএম আর বিজেপি-র সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করছেন। আপনার চক্রান্তের প্রতিবাদে আপনার অফিস ঘেরাও করা হবে। আপনি নিশ্চয় মনে মনে ভাবছিলেন, যার জন্য চুরি করি, সেই বলে চোর! এতকিছু দেখার পরেও চুপ রইলেন, তার এই পরিণাম! সভ্যতা, ভদ্রতা, শিক্ষাদীক্ষা- এগুলো তো নেইই, ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাটুকুও নেই? কী, তাই ভাবছিলেন তো ?
আসলে, পার্থ চ্যাটার্জিরাও আপনার সম্পর্কে তাই ভাবছিলেন। এত আই এ এস থাকতে তোমাকে নির্বাচন কমিশনার করলাম, একটা পুনর্বাসন দিলাম, কোনও কৃতজ্ঞতা নেই ?
এই পারস্পরিক কৃতজ্ঞতার মাশুলই তো দিতে হল বিধান নগরের মানুষকে। এই কৃতজ্ঞতার মাশুলই তো দিতে হল একুশ জন লড়াকু সাংবাদিককে। এই কৃতজ্ঞতার মাশুলই তো দিতে হল প্রাণ হারাণো ইলেকশন এজেন্ট উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়কে।
সোমবার সকাল। আপনি ঘেরাও। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে কারা ধর্নায় বসলেন ? একজনের নাম পরেশ পাল, একজনের নাম পবিত্র বিশ্বাস। এই দুজনই ভোটেরদিন বেআইনিভাবে সল্টলেকে ঢুকেছিলেন, ভোটারদের শাসিয়েছিলেন। সুজিত বসু বা অর্জুন সিং এলে ষোল কলা সম্পূর্ণ হয়ে যেত। আপনার ঘরে চলল সাড়ে চার ঘণ্টার ডেপুটেশন। পার্থ চ্যাটার্জি, সুব্রত মুখার্জিরা সাড়ে চার ঘণ্টা রইলেন আপনার ঘরে। এত দীর্ঘ সময়ের ডেপুটেশন বাংলার রাজনীতিতে আগে কখনও দেখা গেছে ? নিশ্চয় খুব মধুর বাক্য বর্ষিত হয়নি। প্রতিনিয়ত আপনাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভুলে যাবেন না, আমরাই আপনাকে এই চেয়ারে বসিয়েছি।
বেরিয়ে এসে শিক্ষামন্ত্রী হুমকি ছাড়লেন, সাত তারিখেই গণনা করতে হবে। রাজ্যপাল হোক বা নির্বাচন কমিশন যতই চক্রান্ত করুক, সাত তারিখের মধ্যেই ঘোষণা করতে হবে। কাল কলেজ স্ট্রীট থেকে আমাদের শান্তি মিছিল হবে। তার মধ্যে যদি গণনার ঘোষণা না হয়, তাহলে সেই মিছিল নির্বাচন কমিশনের দিকে ঘুরে যাবে। নির্বাচন কমিশনকে এর আগে এই ভাষায় কোনও মন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন ?
তখনও আপনি বোধ হয় জানতেন না বাইরের সেই হু্মকির কথা। বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছি। সব ভিডিও ফুটেজ খতিয়ে দেখতে হবে। সময় লাগবে। তাই কবে পুনর্নির্বাচন হবে, বলা সম্ভব নয়। শোনা যাচ্ছে, সেই সাংবাদিক সম্মেলন চলার সময়ই এসেছিল কোনও জরুরি ফোন। একটু পরেই আবার আপনার ঘরে ঢুকে পড়লেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সুব্রত মুখার্জিরা। কী কথা হয়েছিল, জানা নেই। রাত নটা নাগাদ আপনি আবার ডাকলেন সাংবাদিকদের। ঘোষণা করলেন ৯ তারিখে হবে গণনা।
কটা জায়গায় উপনির্বাচন, বলতে পারলেন না। নিশ্চিত করেই বলা যায়, নাম কে ওয়াস্তে কয়েকটা বুথেই হবে এই উপনির্বাচন। এটাও নিশ্চিন্তে বলা যায়, সেই নির্বাচনও হবে থমথমে আবহে। পুলিশ বা নির্বাচন কমিশন সেই দিনও কার্যত নির্বাক দর্শকই থাকবে।
ভোটের দিন কী সন্ত্রাস হয়েছিল, টিভির কল্যাণে সারা বাংলা দেখেছে। দেখেছে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা। শুধু দেখেননি আপনি। বলে দেওয়া হয়েছিল, মাস্টারমশাই, আপনি কিছুই দেখেননি। আজ পইপই করে সেই কথাটাই আবার আপনাকে বুঝিয়ে দেওয়া হল।
বিধান নগর, আসানসোল বা বালির ভোটারদের অভিজ্ঞতা জানার দরকার নেই। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাতে পারবেন তো? আপনার অফিসের বাইরে কখনও এভাবে কোনও মন্ত্রী হুমকি দিয়েছে ? যারা সন্ত্রাস চালালো,তারা এসে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে জমায়েত করেছে ? আপনার ঘরে এসে কেউ সাড়ে চার ঘণ্টা ডেপুটেশন দিয়েছে ? টানা এতক্ষণ ধরে কেউ কখনও শাসিয়ে গেছে? নিঃসন্দেহে আপনার চাকরি জীবনের সবথেকে অপমানজনক দিনটা আজকে কাটালেন।
বুথের সিসিটিভি দেখতে হবে না। আপনার চেম্বারে যে সিসিটিভি আছে, যদি সেটা অন থাকে, তাহলে রাতে একবার চালিয়ে দেখতে পারেন। দেখুন, হাড়হিম সন্ত্রাস কাকে বলে।
সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়, সন্ত্রাস কাকে বলে, এবার বুঝলেন তো ?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.