পুর ভোট – নাগরিক চোখে

অম্লান রায়চৌধুরী

বেল পাকলে যেমন কাকের কী। আমাদের অবস্থাটাও অনেকটাই সেইরকম।
পুর নির্বাচন মানে, খালি প্রচার–অতি পরিচিত ভঙ্গি- সাধারণ নাগরিকরা স্বভাবতই নিরুৎসাহ- সব মিলিয়ে একটা অযথা সময় কাটানোর মহোৎসব- এই বঙ্গে এখন ।
পশ্চিমবঙ্গের এমনিতেই কর্মসংস্কৃতির উৎকর্ষতে বেশ নাম ডাক আছে- কেউ যদি এই সময় এখানে আসেন ,তাহলে খুবই খুশি হবেন এই দেখে যে – কী চাঞ্চল্য- কী ব্যস্ততা। যে মানুষটা জানে না পাড়ায় কোনও ক্লাব আছে কিনা, সেও হঠাৎ জানতে আসে, ক্লাবের সব কিছু ঠিক ঠাক মতন চলছে তো, অসুবিধা হলে তাকে যেন বলা হয়। এই রকম হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ত্রাতার দেখা পাওয়া যায় এই সময় খুব। পাবলিক এতে অভ্যস্ত। দেখেছে বহুকাল ধরে –রেখাপাত করে না ।
অবস্থান ভেদে চাঞ্চল্যর ধরনটাও পাল্টায়-যখন দেখি পাড়ার একেবারে অচেনা মানুষটিও হঠাৎ তৎপর হয়ে ওঠেন – যিনি গত সাতদিন আগেও ওনার পাশের বাড়ির শশীবাবুর মৃত্যুতে নিজের ঘর থেকে বেরই হলেন না, দলবদ্ধভাবে তিনিই এখন পোষ্টার লাগানোতে, আলোচনাতে ব্যস্ত।
ভুতোদা, অভিজ্ঞ মানুষ, আমাদের ঠেকের প্রানপুরুষ, জনপ্রিয়। এই সব দেখে বল্লেন – আরে এগুলো সব গট আপ কেস, দেখনা– হয়ত ডাক এসেছে , সামনেই কোনও লাফরা আছে, না হয় কোনও লাফরা বাঁধাবে, এটা তারই প্রস্তুতি । দেখিসনি আগে কত মানুষ- পাড়ায় কেমন অচেনা -অফিসে– কর্ম সমিতির ঘরেই খালি মিটিঙে ব্যস্ত – পাত্তা পাওয়াই মুশকিল- বিশাল নেতা। পার্টি অফিসে সেই মানুষটাই আবার – কেমন বাধ্যের মতন – নীতিবাগীশদের নীতি কন্ঠস্থ করছে– হ্যাঁ, পুরস্কার হিসাবে অবশ্য– প্রাইজ পোষ্টিং- কিছু কিছু অনিয়মের ছাড়পত্র পাচ্ছে । এদের প্রয়োজনই মনে হয় না স্থানীয় অবস্থার সাথে নিজেকে জুড়ে দেওয়া। এরা একটা দল সৃষ্ট শ্রেনী ।
special feature2
অথচ এই স্থানীয় অবস্থারই ভবিষ্যত নির্ধারন– পুর ভোটের মাধ্যমে– একেবারে কাছের মানুষের সমস্যা–একদম রান্নাঘরের মেঝেতে বসে সমস্যা শোনা ।এই চরিত্রে আমরা অভ্যস্ত বহুদিন ধরেই। কাজেই এরকম পিস যে পাড়ায় থাকবে না– ভাবলি কী করে। আবহাওয়াটাই তো এই পদ্ধতির পক্ষে উর্বর। সেদিন ভুতোদা ঠেকে বসে এক সুন্দর প্রশ্ন করেছিল, আরে একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনা যে, পুরনাগরিকের ন্যূনতম পরিষেবা, যেমন– পানীয় জল, পরিষ্কার রাস্তাঘাট, রোজকার ময়লা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা, আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার, রাস্তায় জল না জমার ব্যবস্থা- এসবই তো তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে– রাষ্ট্র এগুলোর সুবন্দোবস্ত করতে বাধ্য । এর কোনও অন্যথা নেই। যে পরিষেবা বাধ্যতামুলক – সেগুলো আবার প্রচারের আলোয় আনা যায় নাকি। প্রচার তো সেটারই হবে– যেখানে নিজের ভিন্নতা, নতুন ভাবনা ও তার রূপায়নের পদ্ধতি– হ্যাঁ সাথে কিছুটা অন্য দলের দুর্নীতি বা অনিচ্ছা থাকতে পারে। চলিত প্রচারে সেই প্রশ্নগুলো উঠে আসছে না– তাই সেগুলো অবান্তর মনে হয়। নাগরিক সমাজ চায় না – জানা জিনিসের কচকচানি । আবার তাই নিরুৎসাহ ।

সব থেকে লক্ষ্যণীয় যেটা– এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক বিষয়, যেগুলো পুর প্রতিনিধিদের কর্মকান্ডে আনুষ্ঠানিক ভাবে জোড়া আছে, কিন্তু বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা বেশ দেখা যায়। আশ্চর্য্য লাগে, যেমন নিরাপত্তা- যেটা কিনা সারা ভারতবর্ষের সমস্যা – পশ্চিমবঙ্গও বেশ উপরের সারিতে – এবং যেটার প্রতিরোধে পুর নাগরিকের ঐক্যবদ্ধতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা যে ভীষন জরুরি – সেটার কোনও রূপরেখা নেই প্রচারে।

ভূতোদা বেশ মজা করে বলেন, পাড়ার মোড়টা বড় ফাঁকা ফাঁকা আজকাল– কেমন যেন অচেনা মনে হয়- ছেলেগুলো বেশ জমাট বেধে আড্ডা মারবে, সুন্দরী মেয়ে দেখলে একটু – কখনও লাজুক ভাবে বা কখনও ভীষন স্মার্টভাবে কাছে যাবে, নিজেকে জাহির করবে– একটা সুস্থতা ছিল এই আঙ্গিকটার– কারণ একটা সামাজিক শাসন ছিল, পারিবারিক শৃঙ্খলাবোধ ছিল, ছিল সর্বোপরি পাড়ার দাদাদের ভালোবাসার অনুশাসন। পাড়ার মোড়ের রুপার পানের দোকানই বলে দিত সেদিনকার পাড়ার পালস বিটটা কেমন। অচেনা মানুষ পাড়ায় এলে – প্রথম সিকিউরিটি চেকিংটা পাড়ার মোড়েই হত – এটা একটা প্রচ্ছন্ন নিরাপত্তার বাতাবরণ – পুরোটাই ইন বিল্ট। রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতাটার এমন নির্লজ্জ রুপটাকে দেখা যেত না । এখনকার এই আড্ডাটাই নেই- সত্যি মাইরি, এখন আর সেই জমাট বাঁধাটা দেখি না। মেয়েদের টিটকারি করে যে নির্মল আনন্দটা আমরা উপভোগ করেছি , মনে প্রানে , নিজেদের মধ্যে- ওই আনন্দটাকে কেমন যেন ঘেঁটে গেছে এখন। এই যে সংঘবদ্ধতার একটা বাতাবরণ – তার অভাব পড়ছে – সমাজের সমস্ত স্তরে– নিরাপত্তার অভাব তো ভীষণ ভাবে প্রভাবিত।
কেন এই অভাবগুলো পুর নির্ব্বাচনের প্রধান ক্যাচ লাইন হবে না- কেন পুর প্রতিনিধিরা চাইবেন না– ফিরে আসুক সেই সন্ধ্যাটা যেদিন পাড়ার মেয়েরা নির্ভীক ভাবে চলা ফেরা করবে, অন্য পাড়ার দুষ্কৃতীদেরই শ্যেন দৃষ্টি থেকে সেই মেয়েদেরই রক্ষা করবে সেই পাড়ারই দাদারা। এটাই পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, অনেকদিন ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে-যেটা আজ হারিয়ে গেছে- সাথে নিয়ে গেছে সেই মানসিকতায় লালিত হওয়া একটা যুগকে– সৃষ্টি করেছে কিছু – লোভী, সুবিধাবাদী, ধান্দায় গজিয়ে ওঠা এক শ্রেনী।
ওয়েলফেয়ার – বা নাগরিক কল্যাণের বন্দোব্যস্ত – বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর– কারণ- নাগরিক কল্যাণ বা সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, যার সাথে জড়িয়ে আছে নাগরিক সাংস্কৃতিক চরিত্রটা, যেটার মান উন্নয়নের সাথে ভীষন ভাবে জড়িত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সুস্থ সামাজিক বাতাবরন । পুর নির্বাচনে এগুলোই হওয়া উচিত প্রধান বিষয় , দরকার এর একটা পরিকল্পিত রুপ রেখা । স্থানীয় সংগঠন বা ক্লাবগুলোকে দেওয়া হোউক একটা টার্গেট– নানান কাজের-প্রতিনিয়ত যার updation হবে। কর্মকান্ড জড়িয়ে থাকবে– পাড়ার বা অঞ্চলের প্রত্যেক নাগরিকের একটা মেলবন্ধনের বাতাবরনে, রূপায়িত হবে সুন্দর সর্ব্বজনীন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে– তবেই না পুর প্রতিনিধিকে মনে হবে আমাদের বড় কাছের – দৈনন্দিন সমস্যা বোঝানোর বা জানানোর জায়গা। স্থানীয় পাড়াটা নিরাপদ হবে – অনেক অজানা সুবিধা তৈরি হবে।
এই সব কিছুই মূলত থাকা উচিত প্রচারের আলোতে- যেটা প্রায় নেইই- যেটা নিয়ে কোনও কথা শোনা যায় না। পরিকল্পনার ছবিটা কারুর প্রচারে আদতে আসে না– বা নাগরিক জানতে পারে না । পরিকল্পনা আদতে কিছু আছে কিনা সেটাও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় না ।

বেশ কিছু ক্লাবকে কিছু অনুদান দেওয়া হল– ক্লাবের উন্নতি কল্পে– সেটা কি আবদ্ধ থাকবে শুধু ক্লাব ঘরের রং আর নতুন ঘর বানানোতে– নাকি নিয়মিত হতে থাকবে মানুষকে একত্রিত করার প্রক্রিয়া– যেটা দেবে সুস্থতা – নিরাপত্তা।
যদিও এইভাবে ভাবা হয় বোধ হয় একটু বেশিই আশাবাদী, এমনটা বোধ হয় ভাবার মতন অবস্থা এখন আর পশ্চিমবঙ্গে নেই– এমনকী অতীত ঘাঁটলেও এরকম নিদর্শন পাওয়ার সংখ্যা এতটাই কম যে – সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে না । হ্যাঁ একটা দলীয় আস্তানার জায়গা হয়ত হবে- কাজ কতটা হবে জানা নেই – দেখাও নেই। তাই মেনে নিতে সংশয় ।

তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে এই নির্বাচনটায়– পড়ে রইল কী– শুধু কিছু অঞ্চল- অঞ্চল দখলের নানান রকমের মুসাবেদা – কোনও দলের অফিস ভাঙ্গা , পাল্টা ভাঙ্গা । কোনো অঞ্চলে সুবিধা বেশি হবে, কোথাও কম হবে– বা একদম হবে না। নির্ভর করবে- স্থানীয় নেতার সততা ও কর্মদক্ষ্যতা- কাজ করবার স্বাভাবিক সুযোগ সুবিধা- সরকারের সৌভ্রাতৃমূলক সহযোগিতা।
সাধারন মানুষের কোনও হাত নেই । councilor অবধি পৌঁছোনোটাই এক সমস্যা– তায় আবার পৌছোনোর মাধ্যম গুলোতে দলীয় turnover এর হার এতই বেশি যে রোজই নতুন করে চিনতে লাগে– ফলে সখ্যতা হয় না- গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতন সেখানে আবার বড্ড বেশি দেনা পাওনার বাতাবরণ। অনেকেরই তাই যাওয়া হয়ে ওঠে না। অগত্যা ছেড়ে দাও– আবার– সেই উৎসাহহীনতা ।

এগুলো সবই শুনতে আর ভালো লাগেনা– শুনেও এসেছে মানুষ বহু বছর ধরে , কাজেই নতুনত্ব লাগে না – কিছুই পায় না, তাই উৎসাহও আসে না। পায় কেবল পাড়ার সেই অচেনা মানুষটি, যার সত্যিই- ভূতোদার কথায়, খানিকটা ডাকের তাগিদে আর নিজের আখেরের তাড়নায়।
কিন্তু সেও হয়ত এই বারের মতনই, পরের বার হয়ত দেখব আর এক অথবা আর একদল অচেনা মুখ – অচেনা ভঙ্গীতে শাসাচ্ছে ।

পুর নির্বাচন মানে একটা ঘাঁটি তৈরি করে রাখার আয়োজন । অতএব – সেই আদি অকৃত্রিম বঙ্গীয় দর্শনে- অঞ্চল ছাড়া নেই – যেভাবেই হোউক – আগলে রাখতে হবে দূর্গ – রক্ষা করে রাখতে হবে সেই দূর্গকে আগামী বিধানসভা পর্যন্ত।
সত্যিই কি দুর্দিনে যে কাটাতে হয় দূর্গ বাসীদের ওই সময় গুলোতে – এই ঘন ঘন দূর্গ মালিকের পরিবর্তনে – নিজের জীবনের হিসাব নিকাশ সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। এই অভিজ্ঞতা প্রায় সকলেরই আছে । কিন্তু ধরে রাখতে হবে ততদিন অবধি – পুর নির্ব্বাচনের রেশটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা থাকবে । তার কিছু কিছু নমুনা দেখা যাচ্ছে না যে তা নয়।

আমরা কিন্তু তখনও, এখনকার মতন দেখব- সেই ননীবাবু কে- যে কোনওদিন জল না মাড়িয়ে বাড়িতে ঢুকতে পারেনি। ননীবাবুদের পথ চলার মতন মসৃন হবে কবে, নাগরিক প্রশ্ন করে ।
কবে দেখবে-পাড়ার দাদা রাতে দেরি করে ফেরা মেয়েটাকে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে – ফিরছে বৌদির হাতের এক কাপ চা খেয়ে। নির্বাচনের চলতি এই ধরনটাতে- গল্পটা বড় বেশি একঘেয়ে লাগে- তাই গিলতে বেশ কষ্ট। উৎসাহে ভাঁটা, নতুন চাই – নতুন ভাবে চাই। নতুন নাগরিক, নতুন প্রজন্মও তাই প্রশ্ন করে,
উত্তর আছে কি ?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.