অন্তরা চৌধুরী
গ্রীষ্মকাল এলেই ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। যৌথ পরিবারে
থাকার ফলে বাড়িতে জেড়তুতো–পিসতুতো দাদা-দিদির অভাব ছিল না। তার পরে এসে জুটত তাদের আবার মাসতুতো, মামাতো ভাই–বোনেরা। সব মিলিয়ে সে এক বিরাট বাহিনী। সকলেরই গ্রীষ্মের ছুটি একই সময়ে পড়ত। সবাই এসে হাজির হত আমাদের বাড়িতে। বেশ হই হই করে দিনগুলো কেটে যেত। আমরা সকলেই মোটামুটি সমবয়সী ছিলাম। আমাদের সকলের বড় ছিল বুবাইদাদা। আমার জেঠার ছেলে। ছোটবেলা থেকেই আমরা সবাই তাকে খুব মেনে চলতাম।
দুপুর বেলায় স্নানটান সেরে সবাই একটা করে খাতা নিয়ে বসে যেতাম। এক একটা অক্ষর দিয়ে ফুল, ফল, নাম, দেশ, পদবী লেখার খেলা চলত। কোনওদিন হত অন্তাক্ষরী। এভাবেই নিজের অজান্তে কত নাম শিখে ফেলেছি, কত গান শুনে ফেলেছি। বুবাইদা সেই বয়সেই বাকি সব ভাই বোনগুলোকে তাস খেলায় বেশ পারদর্শী করে তুলেছিল। বাড়ির লোক ছোটদের খেলাধূলার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। তবে দুপুরবেলায় বড়দের ভয়ে খাওয়া দাওয়া করে খুব এক পশলা ঘুমিয়ে নিতে হত। আবার বিকেলবেলায় ক্রিকেট, লুকোচুরি, চোরপুলিশ, বুড়ি বসন্ত এসব খেলতাম।
কিন্তু শুধু গল্প করে আর খেলাধূলা করে তো সময় কাটে না। অন্যরকম কিছু
একটা করতে হবে। কিন্তু কী করা যায়! খেলার শেষে এই নিয়ে রোজ আলোচনাসভা বসত। একদিন ঠিক হল যে শিকার করতে যাব। কিন্তু কোথায় যাব?
আমাদের বাড়ির পেছন দিকে ইউক্যালিপ্টাস গাছের এক বিশাল জঙ্গল ছিল। বেশ
গভীর জঙ্গল। সেখানে ছিল পেল্লাই সাইজের একটা কুয়ো। গ্রীষ্মকালের দিনে
আমাদের কুয়োতে জল শুকিয়ে গেলে দড়ি বালতি নিয়ে আমরা সেখানে স্নান করতে যেতাম। চারপাশে তখন বাড়ি ঘর হয়নি। নির্জন জঙ্গল। চারিদিকে অত বড়বড় গাছের মাঝখানে ওই কুয়োর জলে যত খুশি স্নান কর। কী অদ্ভুত রোমাঞ্চ যে হত! এখন অনেক সুদৃশ্য আধুনিক ব্যবস্থাযুক্ত বাথরুমে স্নান করি। কল খুললেই জল। কিন্তু কষ্ট করে দড়ি দিয়ে তুলে তারপর সেই ঠাণ্ডা জল ঢালার সেই আনন্দ এখন নেই।
যাই হোক, ঠিক হল যে, সবাই মিলে পরেরদিন ওই জঙ্গলেই শিকার করতে যাওয়া হবে। কিন্তু শুধু শিকার করতে গেলেই তো আর হল না। তার জন্য প্রয়োজনীয় সাজ–সরঞ্জাম চাই। বাবুকাকা তখন প্রায়ই কলকাতা আসত। আর আমাদের জন্য প্রত্যেকবারই নিয়ে যেত বিভিন্নরকম টুপি। কোনওবার গান্ধী টুপি, কোনওবার মুসলিম টুপি। সেবারে নিয়ে গিয়েছিল শিকারি টুপি। সেটা সযত্নে রাখা ছিল।
সেটা যে এভাবে একদিন সত্যি সত্যিই শিকারের কাজে লেগে যাবে ভাবিনি।
আমার আর বুবাইদার না হয় শিকারি হ্যাট আছে। কিন্তু বাকিদের? মানে পাপু,
সন্তু, বিটু, ছোটন, ফড়িং এদের তো শিকারি হ্যাট নেই। তাহলে ওরা কী মাথায়
দেবে? অবশেষে ঠিক হল রোদ্দুর আড়াল করার যে টুপি সকলের আছে, সেই টুপি
দিয়েই কাজ চালানো হবে।
টুপি তো হল। কিন্তু শুধু টুপি দিয়ে তো আর শিকার করা যায় না। তার জন্য
বন্দুকও তো দরকার। বুবাইদার একমাত্র বেশ বড় একটা এয়ারগান আছে। কিন্তু
আমরা কী দিয়ে শিকার করব? অনেক খুঁজে অবশেষে দুর্গা পুজোয় কেনা ক্যাপ
ফাটানোর মরচে পড়া অনেকগুলো বন্দুক পাওয়া গেল। আপাতত তাতেই হবে আমদের শিকার পর্ব।
বুবাইদা ছাড়া সারারাতই কেউ উত্তেজনায় ঘুমোয়নি। জীবনে প্রথম শিকার
করতে যাব। দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চারাস ব্যাপার! কী শিকার করতে যাব সেটা
কেউ জানি না। সব জানে আমাদের বুবাইদাদা। সকাল থেকেই আমাদের মধ্যে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। বাড়ির লোকও বেশ নকল উত্তেজনার ভান করছে। আর মুচকি মুচকি হাসছে। যদিও সেটা বোঝার বয়স তখন ছিল না। কাজেই ওদের হাসিকে কেউ পাত্তা দিইনি। আমরা তখন সকলেই খুদে। বুবাইদা সকলের থেকে বয়ঃজ্যেষ্ঠ হওয়ায় সে–ই একমাত্র ফুলপ্যাণ্ট পরার অধিকার পেয়েছিল। সাদা জিন্স, নীল গেঞ্জি, কাঁধে ঝোলানো এয়ারগান, আর মাথায় শিকারি টুপি, চোখে রোদচশমা- সব মিলিয়ে বুবাইদা তখন একেবারে জিম করবেট। আর আমরা তার অন্ধ ভক্ত।
বাড়ি থেকে বেরনোর সময় সকলের সঙ্গে দেখা করে নিলাম। বুবাইদা তো সবাইকে একচোট প্রণাম করে নিল। বাড়ির সবাই দেখলাম আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে বেশ খুশি খুশি একটা ভাব। এদিকে ভয়ে আমাদের সকলের মুখগুলো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কিন্তু মুখ ফুটে কেউ সে কথা বলতে পারছি না। আবার ভেতরে ভেতরে বেশ একটা চাপা উত্তেজনাও কাজ করছে। কি হয় কি হয়! কখন যে কি হয় কেই বা বলতে পারে।
আগেই বলেছি, জঙ্গলটা বেশ ঘন ছিল। পাঁচিল ডিঙিয়ে আমাদের শিকার অভিযান
শুরু হল। বুবাইদা অনেকটা মিলিটারি স্টাইলে কোমর নিচু করে হাঁটতে শুরু
করল। তার দেখাদেখি আমরাও ওই অভিনব কায়দা রপ্ত করে ফেললাম। বুবাইদা আগে আগে চলেছে আমাদের পথ দেখিয়ে। আমরা চলেছি পেছনে পেছনে। একবার করে হাতের ইশারায় থামতে বলে। চারিদিকটা সচকিতভাবে তাকিয়ে নেয়। আবার একবার এগিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। গোটাটাই কিন্তু নির্বাক ভাবে ঘটে চলে। ভাবটা এরকম, কথা বললেই যেন বিরাট কিছু ফসকে যাবে। সবাই একেবারে ভয়ঙ্করভাবে চুপচাপ। একেই গ্রীষ্মকাল। তার ওপর রোদগরমে ক্লান্ত হয়ে একসময় সেই কুয়োর ধারে এসে ধপাস করে সবাই বসে পড়লাল। বুবাইদা কিন্তু তখনও যথেষ্ট সিরিয়াস। এবং শিকার পাওয়ার আশায় যথেষ্ট আশাবাদী।
হঠাৎ বুবাইদা বলে উঠল-‘সবাই কুয়োর চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে জলের দিকে তাকা’। আমরাও যন্ত্রচালিত পুতুলের মত দাঁড়িয়ে ঝুঁকে তাকিয়ে রইলাম জলের দিকে।
-‘কী দেখতে পাচ্ছিস’?
আমরা কেউ কেউ বলে উঠলাম-‘আমাদের মতনই দেখতে কতগুলো ছায়ামূর্তি।’
বুবাইদা অধিক গাম্ভীর্য নিয়ে বলে উঠল,
-‘হুম। এই কুয়োর ভেতরে তোদের মত দেখতে অনেক ভূত আছে’।
ব্যাস! আর যায় কোথায়। সেই শুনে তো আমরা ভয়ে আটখানা। একেই ওইরকম নির্জন জঙ্গল। চারিদিকে একেবারে শুনশান। এক শিকারে রক্ষে নেই আবার ভূত দোসর। হঠাৎ ‘দুম’ করে একটা শব্দ। সবাই প্রচণ্ড চমকে গেলাম। তাকিয়ে দেখি বুবাইদা একটা চড়ুই পাখির উদ্দেশ্যে ফায়ার করেছে। শব্দই সার। পাখি ফুড়ুৎ।
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এসব ঘটনার কথা তাদের মনে আছে কি না কে জানে। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালের জন্য অপেক্ষা করতাম। দিন গুনতাম কবে স্কুলে ছুটি পড়বে। আবার কিন্নরদল একসঙ্গে হবে। আবার নতুন কোনও অভিযান হবে। মনের ভেতর কোনও জিজ্ঞাসা না রেখে বড় দাদার প্রতি ওই যে আনুগত্য এখনকার দিনে বিরল। নিজেদের ছোটবেলার সেই মুখগুলো এখন মনে পড়ে। একরাশ সারল্য, মুগ্ধ দৃষ্টি আর প্রাণখোলা আনন্দ যে কী ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
সবাই এখন সকলের থেকে অনেক দূরে। কালেভদ্রে কখনও হয়তো তাদের সঙ্গে দেখা হয় কি হয় না। সকলেই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। এখন মনে হয় এসব কাহিনি যেন রূপকথা। সেই জঙ্গলটা এখনও আছে। তবে তার ঘনত্ব কমেছে। চারিদিকে লোকজনের বসবাস। কিন্তু সেই কুয়োটা ইতিহাসের সাক্ষীর মত আজও আছে। অ-ব্যবহারে জীর্ণ। চারিদিকে ফার্ন আর শ্যাওলা তার প্রাচীনতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর তার ভেতর রয়ে গেছে আমাদের কিন্নরদলের মত দেখতে কিছু ভূতের প্রতিচ্ছবির স্মৃতি। হ্যাঁ, শুধুই স্মৃতি। বাগানে নতুন কুঁড়ি আসে, প্রজন্ম বদলে যায়, অভ্যেসগুলোও তো বদলে যায়। এখন শিকার হয় মোবাইলে। কে আর পাঁচিল টপকে ওই জঙ্গলে যায়!
আমরা কি সত্যিই খুব বোকা ছিলাম! কী জানি, হয়ত ছিলাম। কিন্তু কেন জানি না, এই মাঝবয়সে এসে সেই বোকামির স্মৃতি রোমন্থন করতে বেশ ভালই লাগে।