রক্তিম মিত্র
বছর দশেক আগের কথা। এক মেয়ের বাবা এসেছেন নিজের মেয়ের বিয়ের বিজ্ঞাপন দিতে। এলেন এক এজেন্সির কাছে। বললেন, আমি আজকাল–এ বিজ্ঞাপন দিতে চাই। সেই এজেন্ট বোঝালেন, আজকালে বিজ্ঞাপন দিয়ে লাভ হবে না। এখানে পাত্র–পাত্রীর বিজ্ঞাপন খুব একটা ছাপা হয় না। তেমন রেসপন্স পাবেন না। বর্তমান বা আনন্দবাজারে দিন। খরচ একটু বেশি। কিন্তু অনেক ফোন পাবেন।
সেই ভদ্রলোক উত্তর দিয়েছিলেন, আমার অনেক ফোন দরকার নেই। মেয়ের জন্য অনেক পাত্রও দরকার নেই। একটি পাত্র পেলেই হবে। আর আমি যেমন পাত্র খুঁজছি, তেমন পাত্র একমাত্র আজকাল থেকেই পেতে পারি। কারণ, আজকাল খুব অল্প লোক পড়ে। কিন্তু যারা পড়ে, তারা সুস্থ রুচির লোক, ভদ্রলোক। ঠিক যেমন পাত্র বা পরিবার আমি চাই।
দশ বছর আগের কথাটা টেনে আনলাম সাম্প্রতিক একটি বিয়ের বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে। বিয়ের বিজ্ঞাপনে কতরকম বয়ান দেখা যায়। এই বয়ানটি একেবারেই অন্যরকম। দীপ্তানুজ দাশগুপ্ত। তিনি তাঁর বোনের বিয়ে দিতে চান একটি বামপন্থী পরিবারে। বিজ্ঞাপনে সেটাই উল্লেখ করেছেন। তা নিয়ে কতই না কটাক্ষ। ব্রাহ্মণ পাত্র চাই বললে আপত্তি নেই, ঘটি পাত্র চাই বললে আপত্তি নেই, ধনী পাত্র চাই বললে আপত্তি নেই, ফর্সা পাত্র চাই বললেও আপত্তি নেই, গোত্র ও রাশি মিলিয়ে পাত্র চাইলে আপত্তি নেই। শুধু বামমনষ্ক পাত্র চাই বলায় এত কটাক্ষ! এই নিয়ে দুটি কাগজে খবর বেরোলো। অবশ্যই বিকৃত দৃষ্টিঙ্গি নিয়ে। যেন বিরাট এক অপরাধ করে ফেলেছেন দীপ্তানুজ। তাই নিয়ে সোশাল (!) মিডিয়ায় কতই না টিপ্পনি! কেউ বলল, এখানে আর বাম পাবেন না। চীনের কাগজে বিজ্ঞাপন দিন। কেউ লিখল, বোনকে বিজেপির ঘরে বিয়ে দিন। কোথাও স্থুল রসবোধ, কোথাও নিম্নরুচির কটাক্ষ।
অনেকেই শিবির বদলেছেন। অনেকেই সুর বদলে ফেলেছেন। কিন্তু দীপ্তানুজকে ধন্যবাদ। এই কঠিন সময়েও তিনি নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসের ওপর আস্থা হারাননি। তাঁর বোনও বাম মনষ্ক। বোনের মতামত নিয়েই এই বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। বেশ গর্বের সঙ্গেই জানিয়েছেন, ‘আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য আমি গর্বিত। আমার বোন সেই মূল্যবোধ নিয়েই বড় হয়েছে। আমি চাই, যে পরিবারে ওর রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে কেউ কটাক্ষ করবে না, সেই পরিবারেই সে যাক।’ দল ক্ষমতায় নেই, অদূর ভবিষ্যতে ফিরবে, এমন নিশ্চয়তাও নেই। তবু দীপ্তানুজ বামমনষ্ক পাত্রই চেয়েছেন। তৃণমূল ক্ষমতায় না থাকলে কজন তৃণমূলি পাত্র চাইবেন, সন্দেহ আছে।
একেবারেই সঠিক কথা বলেছেন দীপ্তানুজ। আমরা এখনও স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে কোষ্ঠী মেলাতে চাই। রাশি–গোত্র–গণ মিলিয়ে পাঁজি দেখে দিন ঠিক করি। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্বাসের মিলটাও জরুরি। রুচিগত মিলটাও জরুরি। এটা তলিয়ে দেখি না। যাঁরা রাজনীতি সচেতন নন, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, বাম মনষ্ক একজন মহিলা যদি এমন একজনের পাল্লায় পড়েন, যে হয় রাম নয় হনুমান নিয়ে মিছিল করতে চায়, তাহলে কেমন হবে? মহিলা সংস্কারমুক্ত, কিন্তু বরের হাতে চারটে–পাঁচটা আঙটি, তাহলে কেমন হবে? বা উল্টোটাও হতে পারে। বর প্রগতিশীল, কিন্তু বউ নানা কুসংস্কারে জর্জরিত।
চোখ খুলে দিলেন দীপ্তানুজ। রাশি–গণ–গোত্র মেলানোর চেয়ে রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিকটা মেলাও খুব জরুরি। রুচির মিলটাও জরুরি। টুকরো টুকরো অমিল থাকতে পারে। কিন্তু মানিয়ে নেওয়ার সহিষ্ণুতাটুকুও থাকুক। দীপ্তানুজ জানতেন, অনেকে কটাক্ষ করবেন। তবু তিনি এগিয়ে এসেছেন। তাঁকে কটাক্ষ নয়। আসুন, তাঁর এই বিজ্ঞাপন নিয়ে আমরাও নতুন করে ভাবি। আসুন, একটা সুস্থ বিতর্কের পরিসর তৈরি করি।