মোহনবাগান জেতার পর আমাদের তাগিদ এল?‌

দেবায়ন কুণ্ডু

ইস্টবেঙ্গলকে বলা হত ভারতের জার্মানি। অর্থাৎ, হারার আগে হেরে বসে না। কিন্তু এখনও তিন ম্যাচ বাকি। অঙ্কের বিচারে কাজটা কঠিন হলেও, এখনও কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ আছে। এর মধ্যেই আমরা কেমন হাল ছেড়ে দিলাম। এর মধ্যেই ধরে নিলাম, আর কোনও আশা নেই। চ্যাম্পিয়ন না হতে পারি, দু নম্বর তো হতেই পারি। কিন্তু আদৌ কি সেই ফোকাসটা আর আছে?‌ এরপর যদি তিন বা চারে নেমে যাই, সেটা কি বেশি গৌরবের হবে?‌ ক্লাব সমর্থকদের সাম্প্রতিক এই বিক্ষোভের পর মনের মধ্যে কয়েকটা প্রশ্ন উকি দিচ্ছে। বেঙ্গল টাইমসের মাধ্যমে সেই প্রশ্নগুলো তুলে ধরছি।

১)‌ ক্লাবে চোদ্দ বছর ট্রফি নেই। এই হাহাকারটা খুব শুনছি। হঠাৎ তো চোদ্দ বছর হয়ে যায়নি। যখন সাত–‌আট বছর ছিল, তখন এই হাহাকারটা তো শুনিনি। যখন নয় বা দশ বছর হয়ে গেল, তখনও তেমনভাবে শুনিনি। তখনও আমরা বছর গোনা শুরু করিনি। শুরু করলাম কবে থেকে?‌ যেদিন পাশের ক্লাবটা আই লিগ জিতল। অর্থাৎ, মোহনবাগান জিতলে আমাদের মধ্যে তাগিদ আসে। মোহনবাগান না জিতলে আমরা বছর গুনতে ভুলে যাই। এই কবছরে আই লিগ ছাড়া আমরা কিন্তু সব ট্রফিই পেয়েছি। এএফসি কাপের সেমিফাইনাল খেলেছি। সেগুলোকি মিথ্যে হয়ে গেল?‌

east bengal club

২)‌ হ্যাঁ, ক্লাবের মধ্যে অনেক গলদ আছে। সেগুলো তো একদিনে তৈরি হয়নি। একটু একটু করে সেগুলো ডালপালা বিস্তার করেছে। এতদিন আমরা সচেতন ছিলাম না। যখন সচেতন হলাম, তখন তার শিকড় অনেকদূর ছড়িয়ে গিয়েছে। খুব দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, আমাদের যা যা গুন ছিল, সেগুলো পাশের ক্লাবে চলে যাচ্ছে। আর পাশের ক্লাবে যা যা বদগুন ছিল, সেগুলো আমরা আয়ত্ব করে নিয়েছি। এভাবে বিক্ষোভ, কোচকে হেনস্থা–‌এগুলো পাশের ক্লাবে হত। আমরা আওয়াজ দিতাম। আজ এগুলো আমাদের ক্লাবেও হতে শুরু করেছে। একদিনে এত সমর্থকের জমায়েত হয়ে গেল। পরিকল্পনা ছাড়া এতবড় কাজ হয়নি। ক্লাবকর্তারা কিছুই আঁচ পেলেন না?‌ নাকি কেউ কেউ মজা দেখতে চাইলেন?‌ কেউ কেউ হয়ত কোচ হেনস্থা হওয়ায় খুশিই হলেন।

৩)‌ শোনা যায় নিম্নমানের বিদেশি এনে কর্তারা কাটমানি খান। অভিযোগটা অনেক পুরনো। আজকের দিনে সবকিছুই পেশাদার। মালিও মাইনে পায়, ক্যান্টিনের ছেলেটাও মাইনে পায়। তাহলে ক্লাবকর্তারাও বেতনভুক হলে ক্ষতি কী?‌ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের টাকা নেই, এমন তো হতে পারে না। পে রোলে যদি কর্তাদের আনা যায়, ক্ষতি কী?‌ সত্যিই তো, বিনে পয়সায় কাজ করার তাগিদ থাকবে কেন?‌ ক্লাবকে ভালবেসে দিনের পর দিন এভাবে সেবা করা যায় না। তাই, আমার প্রস্তাব সচিব থেকে বিভিন্ন কর্তাদের পে রোলে আনা হোক। তাতে তাঁদের দায়বদ্ধতা হয়ত বাড়তে পারে। কাটমানি খাওয়ার হয়ত দরকার পড়বে না।

৪)‌ কোন কোন ব্যাপারে কোচের স্বাধীনতা থাকবে, কোন ব্যাপারে তিনি পরামর্শ করবেন, কোন ব্যাপারে কর্তারা সিদ্ধান্ত নেবেন, তা আগে থেকে পরিষ্কার থাকা দরকার। প্রত্যেকে যেন নিজের দায়িত্ব ও এক্তিয়ার নিয়ে সচেতন থাকেন। কোচ বলছেন, তাঁকে নাকি পছন্দের দল দেওয়া হয়নি। অভিযোগটা কিছুটা সত্যি। কিন্তু কর্তারা কি সত্যিই কোচের পছন্দের ফুটবলারদের আনার চেষ্টা করেছেন?‌ নাকি নিজেদের পছন্দের লোক ঢুকিয়েছেন?‌ এটা কিন্তু পরিষ্কার হওয়া দরকার। এই ব্যাপারে ক্লাবে কোনও স্পষ্ট গাইডলাইন আছে বলেও মনে হয় না। গোটাটাই অস্বচ্ছতা ও লুকোছাপায় মোড়া। সবাই অন্ধকারে।

morgan

৫)‌ মোহনবাগানে টেকনিক্যাল কমিটি আছে। তাঁরা মাঝে মাঝে কোচের সঙ্গে বসেন, মতামতের আদান–‌প্রদান করেন। কিন্তু এখানে তেমন কিছু আছে বলে শুনিনি। প্রাক্তনদের মধ্যে যাঁরা সক্রিয়, তাঁদের কি টিমের সঙ্গে যুক্ত করা যায় না?‌ প্রাক্তনদের ভূমিকা কি শুধু ক্লাবের অনুষ্ঠানে আসা আর বক্তৃতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?‌ প্রাক্তনরা আসতে রাজি নন নাকি কর্তারা প্রাক্তনদের আনতে উৎসাহী নন?‌

৬)‌ সমর্থকদের কতটা গুরুত্ব দেওয়া হবে, সে ব্যাপারেও কোনও স্পষ্ট নীতি নেই। সদস্য–‌সমর্থকদের কাজে লাগানোর আন্তরিক চেষ্টাও হয়নি। কে খেলবে, কে খেলবে না, এটা কি সমর্থকরা ঠিক করে দেবেন?‌ কোচের পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি থাকতেই পারে, সমালোচনা হতেই পারে। তাই বলে কোচকে তাঁরা নির্দেশ দেবেন?‌ তাছাড়া, এই সমর্থকদের কজন দৈনন্দিন খবর রাখেন?‌ যাঁরা ক্লাবের প্রথম একাদশটাও ঠিকঠাক জানেন না, রিজার্ভ বেঞ্চের ফুটবলারদের চেনেন না, তাঁরা ঠিক করবেন কে খেলবে আর কে খেলবে না?‌

৭)‌ কর্তাদের মধ্যে অনেক বিভাজন। কিন্তু আমরা, মানে সদস্য–‌সমর্থকরা কি এক সুরে কথা বলি?‌ এতগুলো ফ্যান ক্লাব কেন?‌ ফেসবুকে এতরকম গ্রুপ কেন?‌ সেই গ্রুপের অ্যাডমিনরাও কি দায়িত্বশীল?‌ নাকি যেমন করে হোক, একটা গ্রুপ খুলে দিলেই হল?‌ সেই গ্রুপে কি পোস্ট হচ্ছে, সেগুলো কি আদৌ খুঁটিয়ে দেখার সময় আছে?‌ যে যা খুশি লিখে চলেছেন, ভাষার কোনও শালীনতা নেই। কেউ একটু অন্য সুরে কথা বললেই খিস্তি–‌খেউড়ের বন্যা শুরু। তাহলে ভেবে দেখুন, সামান্য একটা গ্রুপ ঠিকঠাক চালানো যাচ্ছে না। তাহলে এতবড় একটা ক্লাব চালানো কত কঠিন ব্যাপার। আমার মনে হয়, কর্তাদের সমালোচনা করার আগে আমাদের নিজেদেরও আত্মসমীক্ষা করা উচিত।

আরও অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সবগুলো একসঙ্গে লিখতে গেলে ফোকাস হারিয়ে যাবে। আরও অনেক কথা জমে আছে। ঘরোয়া আড্ডার মোড়কে সেগুলোও না হয় মাঝে মাঝে উঠে আসবে। আমাদের প্রশ্ন, আমাদের ক্ষোভ এভাবেই উঠে আসুক। ক্লাবে হামলা বা কোচকে হেনস্থার মধ্যে দিয়ে নয়। আশা করব, লেখাটি আপনারা পড়বেন। অনেকে হয়ত একমত হলেন না। ফেসবুক কমেন্টে দ্বিমতটাও উঠে আসুক। কথা দিলাম, সেই দ্বিমত শোনার ক্ষেত্রে অসহিষ্ণু হব না।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.