ধীমান সাহা
কোনও মন্তব্য নিয়ে যখনই কোনও বিতর্ক তৈরি হয়, পাল্টা উত্তরটা যেন তৈরিই থাকে। কই, ওরা যে এই বলল, তখন তো কিছু বলেননি। সহজ কথা, ওরাও খারাপ ছিল। তাই আমাদেরও খারাপ হওয়ার অধিকার আছে।
তৃণমূলকে যাই বলতে যান, সেই ৩৪ বছর টেনে আনবে। কিছু হলেই যুক্তি দেওয়া হবে, ৩৪ বছরে এমন অনেক হয়েছে। বিজেপি–র বিরুদ্ধে সমালোচনা হলে তো কথাই নেই। তুলনা চলে আসবে পাকিস্তানের সঙ্গে। অথবা, আপনাকে দেশদ্রোহী বানিয়ে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
এখন দেখা যাচ্ছে, এই কুযুক্তির ফোয়ারায় নব্য বামপন্থীরাও পিছিয়ে নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় গৌতম দেবের মন্তব্যকে ঘিরে যা যা হল, সত্যিই দুঃখজনক। গৌতম দেব মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। অনেকেরই মনে হয়েছিল, গৌতম দেবের এমন মন্তব্য করা উচিত হয়নি। আমিও একজন বাম সমর্থক। আমারও মনে হয়েছে, একজন বামপন্থীর কাছে এটা যথেষ্ট কুরুচিকর। আমার মতো আরও অনেকেরই তা মনে হয়েছিল। কিন্তু তারপর সোশাল মিডিয়ায় যা নমুনা দেখলাম, বোঝা গেল, এরা তৃণমূল বা বিজেপির সঙ্গে তফাত রাখবে না।
কী সব যুক্তি! তাপস পাল যখন বলে, তখন কোথায় ছিলেন? তৃণমূলের কে কখন গালাগাল দিয়ে গেছেন, তার তালিকা দেওয়া হল। যে সব বিশিষ্ট মানুষেরা গৌতম দেবের এই মন্তব্যের সমালোচনা করলেন, তাদের নোঙরা আক্রমণ করা হল। ভাবখানা এমন, বেশ করেছি। তৃণমূল করে, তাই আমাদেরও নোঙরামি করার অধিকার আছে। যদি দু–একজন এমন বিকৃত মতামত প্রচার করে থাকতেন, তাহলে উপেক্ষা করা যেত। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখলাম, তারা সংখ্যায় কম নয়। এবং যে সব বামপন্থী গ্রুপগুলো আছে, সেখানে এইসব মন্তব্য জ্বলজ্বল করছে। এই গ্রুপগুলো কারা চালান? অ্যাডমিনরা সত্যিই তৎপর আছেন তো? তাঁরা সত্যিই বাম মনষ্ক তো?
যা তাপস পালকে মানায়, যা সোনালি গুহকে মানায়, তা গৌতম দেবকে মানায় না। এই সহজ সত্যিটা মানতে পারছেন না কেন? যাঁরা তৃণমূলের সঙ্গে অসভ্যতার প্রতিযোগিতায় নামতে চান, তাঁরা বাম রাজনীতির ভবিষ্যত? সত্যিই মানতে বড় কষ্ট হচ্ছে। সত্যিকারের বামপন্থী হলে এইজাতীয় মন্তব্যের পর কষ্ট পেতেন। মনে হত, অন্তত এর পক্ষে যুক্তি সাজানো উচিত নয়। কোনটা গর্বের আর কোনটা লজ্জার, এই সহজ ব্যাপারটা তাঁরা বোঝেন? সোশাল মিডিয়ায় এঁদের হাতেই বাম পতাকা!
তাপস পাল যখন কুরুচিকর মন্তব্যগুলো করেছিলেন, মনে করে দেখুন, অনেক হাততালি পড়েছিল। সুদীপ্তর স্মরণসভাতেও তাই হল। গৌতম দেব যখন মুখ্যমন্ত্রীর নামে ওইসব মন্তব্য করে চলেছেন, তখনও একটা শ্রেণি হাততালি দিচ্ছিল। টিভিতে পরিষ্কার সেই হাততালি শোনা গেল। কারা হাততালি দিচ্ছিলেন? তাঁরা বাম আদর্শে বিশ্বাসী? মনে হয় না।
তবু ভাল, দেরিতে হলেও গৌতম দেব বুঝলেন। দুখপ্রকাশ করলেন। দলের চাপেই হোক বা নিজে ভুল বুঝতে পেরেই হোক, এই দুঃখপ্রকাশ অবশ্যই স্বাগত। তখনই দেখলাম সুরগুলো বদলে গেল। এতক্ষণ যাঁরা বেশ করেছি বলে চিৎকার জুড়েছিলেন, তাঁদের সুরগুলো কেমন হয়ে গেল। তাঁরা বলতে শুরু করলেন, কমরেড জিন্দাবাদ। কোনটার জন্য জিন্দাবাদ? কুরুচিকর মন্তব্যের জন্য নাকি ভুলস্বীকারের জন্য?
কাগজ খুললে রোজ বাম শিবিরে ভাঙনের খবর পড়তে হয়। কেউ যাচ্ছেন তৃণমূলে, কেউ যাচ্ছেন বিজেপিতে। যাওয়ারই তো কথা। যাঁরা সোশাল সাইটে গৌতম দেবের হয়ে গলা ফাটাচ্ছিলেন, তাঁরাও যে কোনও দিনই যেতে পারেন। কারণ, তাঁদের চিন্তার সঙ্গে, তাঁদের যুক্তির সঙ্গে তৃণমূল বা বিজেপি–র মিল বেশি। তাঁরা চলে গেলেই দলটার মঙ্গল হবে।