ফ্রি ওয়াই ফাই! কে বুদ্ধি দিল ভাই?

সুজিত দে

প্রথমেই বলে রাখি, আমি অবসরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক শিক্ষক। সেইসঙ্গে সদ্য কলেজে পা রাখা এক ছাত্রের বাবা। নিজের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এবং ছেলের বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষার বর্তমান ছবিটা কিছুটা বোঝার চেষ্টা করি।
টিভি বিশেষ দেখা হয় না। তবে কাগজ মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। সকালে একটা খবর পড়ে চমকে উঠলাম। শিক্ষামন্ত্রী নাকি ঘোষণা করেছেন, সব কলেজে ফ্রি ওয়াই-ফাই পরিষেবা চালু হচ্ছে। বাধ্য হচ্ছি নিজের মতামত বেঙ্গল টাইমসের মাধ্যমে তুলে ধরতে। বোঝাই যাচ্ছে, শিক্ষার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রীর তেমন কোনও ধারনাই নেই। কীসে ছাত্রদের ভাল হবে, আর কীসে সর্বনাশ হবে, তিনি বোঝেন বলে মনে হয় না। তাঁর এই সিদ্ধান্তে কম বয়সী কিছু ছোকরা উল্লসিত হতে পারে। কিন্তু একজন শিক্ষক ও একজন অভিভাবক হিসেবে আমি আঁতকে উঠছে। হ্যাঁ, আঁতকেই উঠছি।

free wi fi
শতকরা কতজন ছেলে মোবাইল অ্যাডিক্টেড, সে ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রীর কোনও ধারনা আছে ? আগ্রহ থাকা ভাল, কিন্তু এটা তো আগ্রহ নয়, মারাত্মক নেশা। মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে। রাস্তা দিয়ে যখন পেরিয়ে যাই , ছেলেগুলো ঘাড় তুলে তাকাতেও পারে না। রাস্তায় খানাখোন্দ থাকলে হোঁচট খায়, সামনে থেকে সাইকেল এলে ধাক্কা খায়। বাড়িতে, টিউশনিতে, রাস্তায়, বিছানায়- সর্বত্রই ওদের মোবাইল চাই। সেটা ছাড়া অনেকে পাঁচ মিনিটও থাকতে পারে না।
এই অবস্থায় মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কলেজে ফ্রি ওয়াই ফাই চালু করতে চলেছেন। এতে ছাত্রদের কতটা সর্বনাশ হবে, তিনি বোঝেন না। না বুঝতেই পারেন। কিন্তু এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা তো করতে পারেন। আমার ধারনা, অধিকাংশ শিক্ষকই এর বিরুদ্ধে রায় দিতেন। কারণ, তাঁরা ভুক্তভোগী। আমি হাইস্কুলে পড়াই। সেখানেই এই মোবাইল যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, বিরক্তি এসে যায়। ক্লাসের মধ্যে পেছনের দিকের বেঞ্চে বসে ছেলেরা হোয়াটস আপ, ফেসবুক করছে। কলেজে ছবিটা কেমন, সহজেই অনুমান করতে পারি। স্বীকার না করে পারছি না, নিজের ছেলেকে দেখেই বুঝতে পারছি। এমনিতে বেশ মেধাবী ছাত্রই ছিল। কিন্তু গত এক-দেড় বছরে মোবাইল আসক্তি প্রবল বেড়ে গেছে। কী করে, জানতে চাওয়া শোভনীয় নয়। তবে এটুকু বুঝতে পারি, খুব ভাল কিছুও করে না। অন্তত পড়াশোনা করে না।

wi fi zone

কাগজে দেখলাম, কোনও কোনও ছাত্র বলেছে, ফ্রি ওয়াই ফাই হলে ওদের পড়াশোনার সুবিধা হবে। বিদেশি বই, অন্যান্য ইউনিভার্সিটির বই পড়তে পারবে। ইচ্ছে করছে, কানটা মুলে এক থাপ্পড় লাগাই। ভারী আমার বিদ্যাসাগর। বিদেশি বই পড়ে একেবারে ফাটিয়ে দেবে! বাবাজীবন, কলেজের লাইব্রেরিতে কখনও গেছো ? লাইব্রেরিয়ানকে চোখে দেখেছ ? কখনও লাইব্রেরি থেকে একটা বই তুলেছ ? লাইব্রেরিটা কলেজের কোনদিকে, তা জানো ?
এরা নাকি অন্য ইউনিভার্সিটির বই পড়বে। আর শিক্ষামন্ত্রী এদের কথা শুনে ভাবছেন, তিনি দারুণ কিছু একটা করে ফেললেন। ইতিহাসে তাঁর নাম বোধ হয় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ওয়াই ফাইয়ের লোভ দেখিয়ে ছাত্রদের কলেজে ডেকে আনতে হবে? শিক্ষার মান এতটা নেমে গেল ? যদিও বা আসে, তাকে ক্লাসে পাঠানো যাবে ? সে তো কমনরুমে বা ক্যান্টিনে বা ফাঁকা গাছের তলায় মনের সুখে ওয়াই ফাইয়ের পরিষেবা নেবে। আর যদিওবা ক্লাসে যায়, পড়ায় কতটা মন থাকবে, বলা মুশকিল। সামনে বসে থাকা ছাত্ররা যদি মোবাইলের দিকে মগ্ন থাকে, তাহলে শিক্ষকের পক্ষেও পড়ানো কঠিন।
এসব কোনওকিছুই শিক্ষামন্ত্রী ভেবেছেন বলে মনে হয় না। পার্থবাবুকে অনুরোধ, না বুঝে ঘোষণা করেছেন। এবার আসল সমস্যা বুঝে সেই ঘোষণা প্রত্যাহার করুন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.