হারিয়ে গিয়েও রয়ে গেছেন প্র না বি

১৯৮৫ সালের ১০ ই মে এই দিনটিতে প্রমথনাথ বিশী আমদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন । কেমন ছিলেন রসিক প্রমথ নাথ ? কেমন ছিলেন মানুষ বিশীদা ? লেখক ঔপন্যাসিক,সমালোচক এবং অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশীর স্মৃতিচারণায় লেখক প্রকাশক সবিতেন্দ্রনাথ রায় ।
তাঁর স্মৃতিচারণ শুনে এসে লিখলেন শোভন চন্দ ও অয়ন দাস

মহাত্মা গান্ধী রোডের ট্রাম লাইন পেরিয়ে একটু গিয়েই শেষ হয়েছে । এই রাস্তার ওপরেই একটি ঘরে বইয়ের কাউন্টারটি ।একটি দরজা নির্দিষ্ট ব্যবসা করার জন্য, আর একটি দরজা ও টেবিল প্রায় বেদখল হয়ে যায় কোনও কোনও সময়ে সাহিত্যিক ও সাহিত্যমোদীদের আড্ডার জন্য। যেদিনের কথা বলছি , সেদিন বেশ আড্ডা চলছে, সময়টা শীতকাল।আড্ডার মধ্যে খর্বকায় মানুষটি যেন মধ্যমণি। তাঁর এক একটি মন্তব্যে হইহই হাসি উঠছে। মানুষটি শীতকাতর। গায়ে প্রচুর শীতবস্ত্র দেখলেই তা বোঝা যায়।কিন্তু সেজন্য মানুষটির রসবোধের খামতি নেই। এমন সময় পথচলতি মানুষদের একজন সেই আড্ডা দেখেই থমকে দাঁড়ালেন।চেচিয়ে উঠে বললেন – এই তো বিশীদা তোমায় খুঁজছিলাম।
লোকটি বললেন-ওই যে একটা শ্লোক আছে না?প্রথম তিনটি লাইন ভুলে গিয়েছি,একটু বলবেন?ওই তিনটি গুণ কী কী? বিশীদা উত্তর দিলেন- বিলক্ষণ, মাঘের তো তিনটি গুণ- বাত পিত্ত ও কফ- তিনটেই বড় কষ্টদায়ক। আড্ডার সবাই এবং প্রশ্নকর্তাও সমস্বরে হেসে উঠলেন – সত্যি, বিশীদা,এমন চমৎকার উত্তর আপনি খুঁজে পান কী করে?
এতক্ষণে নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক হলেন লেখক অধ্যাপক রসজ্ঞ –সমালোচক প্রমথনাথ বিশী। এর মাঝেই একজন বলে উঠলেন তা বিশীদা যাই বলুন আপনি একটু শীতকাতুরে।শীত পড়েছে তবে আপনার মত কারও এত জামা কাপড় নেই আজ কটা পরেছেন? বিশীদা বললেন ক্লাসে ছেলেরাও তাই বলে। তারা কোট সোয়েটার জামা দুটো লম্বা হাতা গেঞ্জি গুণে বলল- স্যার,৫টা আমি বললাম ভেতরে দুটো হাতকাটা গেঞ্জি আছে। সবসুদ্ধ ৭টা।আড্ডার সবাই হেসে উঠলেন। একজন বললেন, আর একটু শীত পড়লেই আপনি পরশুরাম গল্পের নকুড়মামা হয়ে যাবেন।

pramathnath2

আড্ডার মাঝে প্রমথ বাবু বলে উঠতেন আমার বিরুদ্ধে তো অনেক কথা হল, এবার কফি হাউস থেকে তিতো ডালপোড়া গন্ধওলা কফিটা আনান।কলেজ স্ট্রিট বই পাড়ায় দুটি আড্ডার জায়গা ছিল একটি মিত্র-ঘোষ নবীন সাহিত্যিকদের এই আড্ডাটির নাম হাউস অব কমনস, আর এম-সি-সরকারে প্রবীণদের এই আড্ডাটির নাম ছিল হাউস অব লর্ডস।দুটি নামই প্রমথ বাবুর দেওয়া।
মাত্র ন’বছর বয়সে প্রমথ নাথ ও তাঁর ছোট ভাই ১৯১০ সালে আষাঢ় মাসে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে পড়তে এলেন। ছোট ভাইটি পরে ফিরে গেলেও প্রমথনাথ রয়ে যান।রবীন্দ্রনাথ তখন ছাত্রদের নিজে পড়াতেন। সে সময়ে শান্তিনিকেতনে এক এক ছেলেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভর্তি করা হত।প্রমথ বাবু গণিতে কাঁচা তাই বরাবর এক শ্রেণি নীচে পড়তেন। একবার অঙ্ক পরীক্ষার খাতায় উত্তরে লেখেন – হে হরি দয়াময়
হইয়া সদয়………..
ইত্যাদি যা রীতি মতো রবীঠাকুরের নজর কেড়েছিলেন।রবীন্দ্র সান্নিধ্যে সতেরো বছর শান্তিনিকেতনে বাস প্রমথ বাবুর জীবনে এক অমূল্য সঞ্চয়।একদিন সাহিত্য বাসরে একটি লেখা যার মধ্যে একটি শব্দ ছিল “ট্যাক্সিতে” সেটি দেখে এবং প্রমথের কাছে তাঁর ব্যখ্যা শুনে রবীন্দ্রনাথ খুব হেসে ছিলেন ।শান্তিনিকেতনে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। এম এ পাশ করার পর তিনি রামতনু লাহিড়ী বৃত্তি নিয়ে বাংলায় গবেষণা শুরু করেন।এই গবেষণার ফল তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ গ্রন্থ –রবীন্দ্রকাব্যপ্রবাহ যা আজও রবীন্দ্র কাব্য গবেষণায় এক অনন্য সহায়।
প্রমথ বাবু কর্ম জীবনে অধ্যাপক ছিলেন তিনি রিপন কলেজে অধ্যাপনা করতেন। একদিন আমাকে বললেন ভানু বাবু চলুন যাই আসলে উনি কাউকে সঙ্গে না নিয়ে সাধারণত ট্রাম লাইন পেরোতেন না তারপর লাইন পেরিয়ে আমাকে নিয়ে উপস্থিত হলেন তাঁর পুরন মেসের সামনে ।সত্যি খুব মজার মানুষ ছিলেন। আনন্দবাজারে যখন সহ সম্পাদকের কাজ করতেন তখন দুটি অসাধারণ সম্পাদকীয় লিখেছিলেন।তৎকালীন সরকারের অপদার্থতার জন্য “মজন্তালী সরকার” এবং নোয়াখালীতে গান্ধীজির প্রচেষ্টা নিয়ে লিখেছিলেন “শ্মশানে এক সন্ন্যাসী”।

keri saheb

তিনি একেবারে সরল জীবনযাপন করতেন। তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউ জি সি অধ্যাপক। একবার প্রবল বৃষ্টি হয়ে জল জমে গেছে সবাই ভাবছে কী করবে।প্রমথ বাবু এক ছাত্রের ছাতার নীচে তাঁর কাঁধ ধরে এক হাতে জুতো নিয়ে অম্লান চিত্তে আড্ডায় এসে বসলেন। ছাত্রদের সঙ্গে সমান ভাবে মিশতেন। মানুষটি সমগ্র জীবনে বহু সাহিত্য রচনা করেছেন সমালোচনা করেছেন জোড়াদীঘির উদ্যাস্ত,লালকেল্লা কেরী সাহেবের মুন্সীর মতো উপন্যাস লিখেছেন কবিতা লিখেছেন। আজও মনে পড়ে একদিন আড্ডার মধ্যে দুটি গানের মধ্যে বা দুটি গল্পের মধ্যে কী কী লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ,কোনও যোগসূত্র আছে কিনা এই আলোচনাতেই লিখে ফেললেন রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের মত অনবদ্য আলোচনা গ্রন্থ।আর কোনও শান্তিনিকেতন বাসী এমনভাবে রবীন্দ্রচর্চা করেন নি।একদিন আড্ডাতে বিশীদা বলছিলেন শান্তিনিকেতনে তিনি সাহিত্য- নাটক চর্চা করেছেন কিন্তু গান শেখা হয়নি।কী বলছেন শান্তিনিকেতনে ছিলেন কিন্তু গান শেখেননি! আড্ডার এক সঙ্গী একটু অবাক হলেন, তাঁকে আবার এই একই কথা জিজ্ঞেস করলেন । তখন প্রমথদা হঠাৎ বললেন তোমার বাড়ি কোথায়? সঙ্গী বলল দমদমে তিনি বলে উঠলেন প্লেন চালানো শিখেছ? এমনি মজার মানুষ ছিলেন ।
১৯৮৫ তে তিনি চলে গেলেন কিন্তু জমাট আড্ডা বসলে চশমার আড়ালে সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখ ও মন্তব্যের জন্য এখনও আমার মন কেমন করে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.